বাংলার বাণী
১২ই মার্চ, ১৯৭৩, সোমবার, ২৮শে ফাল্গুন, ১৩৭৯ বঙ্গাব্দ
এটাই হোক শেষ পদক্ষেপ
এ মাসের বিশ তারিখের মধ্যে বেআইনী অস্ত্র জমা দেয়ার এক জরুরী নির্দেশ ঘোষণা করা হয়েছে গতকাল। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গত পরশুদিন এক ঘোষণায় জানিয়েছেন—যাদের কাছে বেআইনী অস্ত্র রয়েছে তারা যেন এ মাসের বিশ তারিখের মধ্যে নিজস্ব থানায় জমা দেয়। বঙ্গবন্ধু এ ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে এক বিজ্ঞপ্তিতে বিস্তারিতভাবে জানানো হয়েছে যে, যারা উল্লেখিত সময়ের মধ্যে অস্ত্র জমা দেবে তাদের বিরুদ্ধে কোন রকম আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবেনা। আরো জানানো হয়েছে যে, যাদের কাছে রিভলবার বা পিস্তল ধরনের ছোট অস্ত্র রয়েছে তারা থানায় জমা দেয়ার সময় তাদের অস্ত্র রাখার নিয়মিত লাইসেন্সের জন্যে আবেদন করতে পারেন। যারা এই আদেশ পালনে ব্যর্থ হবেন তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। ১৯৭২ সালের প্রেসিডেন্টের পঞ্চাশ নম্বর আদেশ অনুযায়ী সর্বনিম্ন তিন বছর ও সর্বোচ্চ চৌদ্দ বছরের সশ্রম কারাদন্ড প্রদান করা হবে।
নতুন সরকার গঠনের পূর্বেই বঙ্গবন্ধু অস্ত্র উদ্ধারের এক শক্তিশালী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। ইতিপূর্বে বঙ্গবন্ধু বিভিন্ন সময় অস্ত্র সমর্পণের জন্যে অনুরোধ জানিয়েছেন। দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধারা বঙ্গবন্ধুর নিকট অস্ত্র সমর্পণ করে বিশ্বের ইতিহাসে এক নতুন উদাহরণ সৃষ্টি করেছিলো। এখনও দেশে প্রচুর অস্ত্র রয়েছে। সমাজ বিরোধী ব্যক্তিরা সে সকল অবৈধ অস্ত্র দিয়ে দেশের মানুষের জীবন দুর্বিষহ করে তুলেছেন। রাতে মানুষ ঘুমুতে পারেনা শান্তিতে। বঙ্গবন্ধু বার বার বলেছেন-আমার দেশের মানুষ নানা দুঃখের মাঝে কালাতিপাত করলেও তারা ততটুকু ক্ষুব্ধ নয় যতটুকু ক্ষুব্ধ তারা দুষ্কৃতিকারীদের দ্বারা জীবনের হুমকির জন্যে। তারা শান্তিতে বিশ্বাসী। অস্ত্রের হুমকির মুখোমুখি তাঁরা দাঁড়াতে চায় না। বঙ্গবন্ধু ও তাঁর সরকারের সামনে আজ এই একটি মহান দায়িত্ব রয়েছে তা হলো—মানুষকে জীবনের নিরাপত্তা বিধান করে দেশের সমাজবিরোধীদের কাছ থেকে অস্ত্র উদ্ধার করা। নির্বাচনে বিপুলভাবে জয়লাভ করার পর স্বাভাবিক ভাবেই আজ দায়িত্ব এসে গেছে সরকারের উপর। আর সে কারণেই অস্ত্র সমর্পণের শেষ নির্দেশ ঘোষণা করা হয়েছে। ঘোষণায় একটি মহত মনের পরিচয়ও সরকার দিয়েছেন। যারা এখন অস্ত্র সমর্পণ করবে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত কোন ব্যবস্থা নেওয়া হবেনা। এমনকি যারা রিভলবার ও পিস্তল রাখতে চায় তারাও নিয়মিত লাইসেন্সের জন্যে দরখাস্ত করতে পারবে।
অস্ত্র সমর্পণের জন্যে বহু সময় দেওয়া হয়েছে। এবার সত্যিকারভাবেই সরকারকে কিছু করতে হবে। বাংলার শান্তিপ্রিয় মানুষকে আর অনিশ্চয়তার মাঝে রাখা যাবেনা। সরকারের সকল শক্তি নিয়োগ করে অস্ত্র উদ্ধার করতে হবে। দেশের জনগণ এ ব্যাপারে নিশ্চয়ই সহযোগিতার হাত নিয়ে এগিয়ে আসবে। অস্ত্র উদ্ধারের ব্যাপারে সরকারের কোন প্রকার শিথিলতাই দেশবাসীর কাছে আর গ্রহণযোগ্য হবেনা।
প্রকাশ্যে নয় চোরাগলি পথে—
পাকিস্তানী প্রেসিডেন্ট মিঃ জুলফিকার আলী ভুট্টোর বিশেষ দূত জনাব মুস্তফা খার ফিরে এসেছেন ওয়াশিংটন থেকে। রওয়ানা হয়েছেন পাকিস্তানের প্রধান সেনাপতি জেনারেল টিক্কা খান জর্দানের পথে। জর্দানের রাজা হোসেন প্রেসিডেন্ট নিক্সনের সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ বহু আলোচনা শেষে এই ক’দিন আগে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেছেন। জেনারেল টিক্কা জর্দান যাবার পথে একবার নেমেছিলেন ইরানে। রথী-মহারথীদের এই আনাগোনা তাৎপর্যপূর্ণ। রাজনৈতিক জ্ঞান যাদের সামান্যতম রয়েছে বিশেষ করে পাকিস্তান, ইরান, জর্দান এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের ব্যাপারে যারা এতটুকু ওয়াকেবহাল তারা বিষয়গুলো গুরুত্বের সঙ্গে পর্যালোচনা করছেন। সে বিচার বিশ্লেষণ থেকে বাদ পড়ছেনা জেনারেল টিক্কার সাম্প্রতিক পিকিং সফর এবং মিসেস ভুট্টোর চীন গমন।
মুস্তফা খার প্রত্যাবর্তন করেছেন। বলা হয়েছে তার ওয়াশিংটন সফর ব্যর্থ হয়েছে। মার্কিন কংগ্রেস সদস্যদের সঙ্গে তার আলোচনায় বসার কথা ছিলো। কিন্তু সে বৈঠকের পূর্বেই তিনি মার্কিন ভূমি পরিত্যাগ করেছেন। কংগ্রেসের সঙ্গে তার আলোচনা স্বাভাবিকভাবেই প্রকাশ্য ব্যাপার হয়ে যেতো। কেউ কেউ ভাবছেন সেই প্রকাশ্য মত বিনিময়টাকে এড়াবার জন্যই মুস্তফা খার নির্ধারিত সময়ের পূর্বেই ওয়াশিংটন ত্যাগ করেছেন। প্রেসিডেন্ট নিক্সন এবং সেক্রেটারী অব স্টেট উইলিয়াম পি রজার্সের সঙ্গে জনাব মুস্তফা খারের আলোচনার বিষয়বস্তুও অজানা কারণে গোপন রাখা হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বরাষ্ট্র বিভাগের মুখপাত্র মিঃ চার্লস ব্রে সত্যই বলেছেন, তার সরকার ভারত উপমহাদেশের পক্ষগুলোর স্বার্থ সংশ্লিষ্ট ব্যাপারে প্রকাশ্যে জড়িত হবে না।
প্রকাশ্যে জড়িত না হলে কি হবে, অতীত অভিজ্ঞতা থেকে দেখা গেছে উপমহাদেশের বিভিন্ন সমস্যায় যখন প্রত্যক্ষভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের জড়িত করতে দ্বিধাবোধ করেছে তখনই বিভিন্ন রাষ্ট্রের মাধ্যমে মার্কিনী প্রভাব কার্যকরী হয়েছে এ সকল দেশে। ভারত এবং পাকিস্তানে অস্ত্র সরবরাহ বন্ধ করার পরও দেদার মার্কিনী অস্ত্র এসেছে সৌদি আরব এবং ইরানের মাধ্যমে। এবারও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যখন পাকিস্তানকে প্রকাশ্যে অস্ত্র সরবরাহের প্রশ্নটি নাকচ করে দিয়েছে তখন মিঃ ভুট্টোরই আর এক সামরিক দূত গিয়ে পৌছেছেন ইরান হয়ে জর্দানে। উপমহাদেশের সাম্প্রতিক ঘটনাসমূহে নাকানি চুবানি খাওয়ার পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যে প্রকাশ্যে পাকিস্তানের স্বপক্ষে বড় কোন সিদ্ধান্ত নেবেন না এটা অনেকটাই জানা ছিলো। কিন্তু প্রশ্ন হলো তার চোরাগলি পথ দিয়ে। এই চোরাগলি পথে যতদিন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার পাকিস্তান প্রেম অব্যাহত রাখবে ততদিন প্রকাশ্যে উপমহাদেশের বিষয়ে তাদের জড়িত না হবার আশ্বাস খলতার সামিল বলে বিবেচিত হবে।
এ প্রবণতা বন্ধ হোক
পত্রাস্তরে প্রকাশ, বাজারে চালের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। চালের দাম বাজার দর থেকে ঊর্ধ্বমুখী হওয়ায় শংকাও প্রকাশ করা হয়েছে। দেশ স্বাধীন হবার পর দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে সত্য। তবে বাজার দরের স্থিতিশীলতা এক রূপ বজায় থেকেছে এটাও সত্য। দেশের চাল বা নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধির কারণ সম্পর্কে সকলেই কম বেশী অবহিত। ১৯৭১ সালের বছর ছিলো বাংলাদেশের ক্রান্তি লগ্ন। সে সময়ে না খাদ্যশস্য না অন্যান্য শিল্পদ্রব্যের উৎপাদন হয়েছে। তদুপরি যে খাদ্যশস্য গুদামজাত ছিলো সেগুলোও পাক বাহিনী পুড়িয়ে দিয়েছিলো, লুন্ঠন করেছিলো বা ধ্বংস করেছিলো। মাঠের ফসলাদিও ধ্বংস করেছিলো তারা। এই সকল অনিবার্য কারণগুলোর মাঝে যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের অবস্থা করুণ ছিলো। একদিকে খাদ্যশস্যের ভান্ডার শূন্য অপরদিকে উৎপাদনে কমতি, সবকিছু মিলে দেশের যে বড় সমস্যা দেখা দিয়েছিলো সেটা খাদ্য সংকট সমস্যা। দুর্ভিক্ষ সমাসন্ন হয়ে উঠেছিলো দেশে। দৃঢ়সংকল্প ও প্রচেষ্টার মাধ্যমে সে সমস্যার মোকাবেলা করতে হয়েছে সরকারকে। দেশ-দেশান্তর থেকে সাহায্য ও আমদানীকৃত খাদ্যশস্য দিয়ে এই সমস্যার যথাযথ মোকাবেলা করেছে সরকার। দেশে অসাধু ব্যবসায়ীদের অন্যায়ভাবে খাদ্যদ্রব্য মওজুতকরণ ও মওজুতমাল পরে ঊর্ধ্বমূল্যে বিক্রি করার জন্যও খাদ্য সংকট বেশ প্রকট হয়ে উঠেছে। এই মওজুতকরণ একদিকে যেমন খাদ্য সরবরাহে অপ্রতুলতা সৃষ্টি করছে অন্যদিকে এর ঊর্ধ্বমূল্যে বিক্রি জনগণকে বিশেষ সমস্যা ও কষ্টের কবলে ফেলেছে। এর একটা সমাধান নিশ্চয়ই খুঁজে পেতে হবে। এজন্য সকলকেই সচেষ্ট হওয়া বাঞ্ছনীয়। কিন্তু এ সমস্যাকে অতিরঞ্জিত করে দলীয় স্বার্থসিদ্ধির কাজে ব্যবহার করা উচিত নয় নিশ্চয়ই। বাজারে দ্রব্যমূল্যের মান একটা বিশেষ স্থিতিশীল পর্যায়ে থাকলে জনগণকে অত্যন্ত মূল্যে উঠানামার অস্থিতিশীলতা সমস্যা বা এরূপ বিপদের সম্মুখীন হতে হয় না।
এ ব্যাপারে আমাদের সচেতন হওয়া উচিত। কিন্তু কেউ কেউ এই বাজার দরের খবর না রেখেই এমনভাবে তার ব্যাখ্যা পত্র-পত্রিকায় দিচ্ছেন সেটা আমাদের জন্য আরো বিপদসংকূল হয়ে উঠেছে। কেননা হঠাৎ করে যদি সংবাদপত্রে সংবাদ উঠে চালের বর্তমান বাজার দর ১০০ বা ১১০ টাকা, তাহলে এটা স্বাভাবিক যে, ব্যবসায়ীরা সে কথার সত্যতা বিচার না করে নিজেদের নিম্ন বাজার দরকে অস্থিতিশীল করে তুলবে—তারাও অনুরূপভাবে বাজার দর ঊর্ধ্বমুখী করবে। এতে বিপদে পড়বে জনগণ। তাই সকলের উচিত সংবাদ সরবরাহে মিথ্যার আশ্রয় না নেওয়া। জনমনে সন্ত্রাস সৃষ্টি না করা ও জনগণকে এভাবে সমস্যার আবর্তে আরো বেশী করে নিমজ্জিত না করা। এ প্রবণতা কোন অবস্থাতেই দেশের বৃহত্তর মঙ্গলের স্বপক্ষে নয়।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক