বাংলার বাণী
১৩ই মার্চ, ১৯৭৩, মঙ্গলবার, ২৯শে ফাল্গুন, ১৩৭৯ বঙ্গাব্দ
মুজিববাদী সমাজ প্রতিষ্ঠাই লক্ষ্য
লক্ষ্য শুধু শুদ্ধি অভিযানেরই নয় সারা বাংলায় সাড়ে সাত কোটি মানুষের চরম লক্ষ্য মুজিববাদের ভিত্তিতে একটি শোষণহীন সুখী সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তোলা। ক’দিন আগেও যা ছিলো একটি দলের দাবী আজ সাধারণ নির্বাচনোত্তরকালে তা হয়ে দাঁড়িয়েছে সমগ্র জনমানসের আশা আকাঙ্ক্ষার প্রতীক। সাধারণ নির্বাচনে এটাকে একটা ম্যান্ডেট হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছিলো। সে ম্যান্ডেট জনগণ দিয়েছে। এখন অগ্রযাত্রার পালা। সেই মহান আদর্শ বাস্তবায়নের পথে পা রাখতে বাংলায় যুব সমাজ সেদিন একত্রিত হয়েছিলো বায়তুল মোকাররম প্রাঙ্গণে। এসেছিলো শ্রমিক মেহনতী মানুষ, ক্ষুদে দোকানদার, সীমিত আয়ের অসংখ্য জনতা। এক কন্ঠে তারা ঘোষণা করেছে একটা সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক সংগ্রাম তথা শুদ্ধি অভিযানের মাধ্যমে তারা বঙ্গবন্ধুর আজীবন তপস্যার ধ্যান স্বাধীন বাংলাকে সোনার বাংলায় রূপান্তরিত করবে। সমাজের সকল স্তর থেকে অন্যায়, অত্যাচার, দুর্নীতি ও শোষণকে উৎখাত করে মুজিববাদী সমাজ গঠনে তৎপর হবে। এটা জনতার রায়, জনতার বিজয় লক্ষ্য।
আন্দোলনটা সুকঠিন এবং দায়িত্বপূর্ণ। কোন হঠকারিতা এর পথে শুধু অন্তরায়ই হয়ে দাঁড়াবেনা বরং সার্বিক আন্দোলন নস্যাৎ করে দিতেও উদ্যত হবে। সুতরাং অজ্ঞাত পরিকল্পিত উপায়ে সমাজের বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে সুস্পষ্ট স্তরানুক্রমিক লক্ষ্যকে সামনে রেখে আমাদের আগাতে হবে। প্রতিক্রিয়াশীল চক্র, দেশী-বিদেশী রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র আমাদের প্রতি পদক্ষেপ বাঁধার সৃষ্টি করবে। ভাবাবেগ অথবা অন্যায় উন্মাদনার সৃষ্টি করে জনচেতনাকে বিভ্রান্ত করতে চাইবে, অহেতুক আতঙ্ক এবং সন্ত্রাস সৃষ্টি করে চাইবে মূল লক্ষ্যে গিয়ে যাতে আমরা পৌঁছাতে না পারি। সবদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখবার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে তাই প্রথম থেকেই।
বাংলাদেশের সরকার আমাদের গণপ্রতিনিধিত্বশীল সরকার। বিগত সাধারণ নির্বাচনে জনগণ পূর্বের তুলনায় প্রকৃতপক্ষে আরো বেশী করে তাদের উপর আস্থা জ্ঞাপন করছে। ক’দিনের ভিতরই নতুন সরকার গঠিত হতে চলেছে। আমরা জানি জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সরকার যে নীতিসমূহ গ্রহণ করেন তা বাস্তবায়নের দায়িত্ব অর্পিত হয়ে থাকে প্রশাসনিক কর্মীদের উপর। বিগত এক বৎসরেরও অধিককালের অভিজ্ঞতা থেকে দেখা গেছে সরকারের বিভিন্ন প্রগতিশীল নীতি বানচালের জন্য এই প্রশাসন কর্মীদের একটা বড় অংশ প্রতিক্রিয়াশীল চক্রান্তের সঙ্গে হাত মিলিয়ে বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে। সেই তিক্ত অভিজ্ঞতার পরিপ্রেক্ষিতে আজ অত্যন্ত যুক্তিসঙ্গতভাবেই দাবী উঠেছে নতুন সরকারের সঙ্গে চাই নতুন প্রশাসন। শুধু নতুন মুখ নিলেই সকল সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে এটা আমরা ভাবিনা। বরং পুরোন প্রশাসন কর্মীদের মধ্যে যারা প্রতিক্রিয়াশীল চিন্তা চেতনায় ডুবে রয়েছেন তাদেরই অবিলম্বে অপসারণ করতে হবে। প্রাথমিকভাবে এই প্রশাসন ব্যবস্থাকে অবশ্যই গণমুখী তথা মুজিববাদ ভিত্তিক করে গড়ে তুলতে হবে। এটা আমাদেরই নয়—সাড়ে সাত কোটি মানুষের রায়। প্রশাসন ব্যবস্থাকে প্রগতিশীল করে তোলা এটা মুজিববাদী সমাজ গঠনের একটা স্তর মাত্র। এমনিভাবে সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে আমাদের শুদ্ধি অভিযান পরিচালনার প্রয়োজন রয়েছে। আর এই আন্দোলন পরিচালনা তথা এর লক্ষ্যসমূহ বাস্তবায়নের জন্যও প্রয়োজন রয়েছে ‘সোনার ছেলে।’ বাংলার প্রগতিশীল কর্মীদের কাছে তাই আমাদের আহ্বান নিজেদের নয়া সমাজ গঠনের যোগ্য সৈনিকরূপে গড়ে তুলে এই বাংলাকে সকল শোষণ, অন্যায় ও দুর্নীতির হাত থেকে মুক্ত করুন। ভবিষ্যৎ বংশধরদের জন্য যেন আমরা শোষণহীন, সুখী, সমৃদ্ধিশালী একটা সমাজ রেখে যেতে পারি। সুমজ্জল সেই ভবিষ্যতের প্রত্যাশায় বাংলার লক্ষ্য কোটি মানুষ আজ ঐক্যবদ্ধ।
পাকিস্তানে সংবাদপত্রের কন্ঠরোধ
পিন্ডি থেকে এসোসিয়েটেড প্রেসের প্রতিনিধি জানিয়েছেন পাকিস্তানে সংবাদপত্র, বেতার, টেলিভিশন ও অন্যান্য গণ-সংযোগ মাধ্যমের উপর ভুট্টো সরকার বেশ কড়াকড়িভাবে নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা জোরদার করেছেন। সংবাদ মাধ্যমের উপর এই কড়া সেন্সর ব্যবস্থা আরোপ কেন? পাক প্রেসিডেন্ট মুখে যে গণতন্ত্রের বুলি কপচান তার অন্তর্নিহিত রূপ প্রকাশ হয়ে না পড়ে সে জন্যে! পাকিস্তানের রাজনীতিতে পূর্বেও ভুট্টোর মত বহু নেতাকে গণতন্ত্রের টুটি চেপে ধরতে দেখা গেছে। গণতন্ত্রকামী মানুষের শ্বাসরোধ করে দেশে স্বৈরতন্ত্রের রাজত্ব কায়েম করেছে তারা। জনগণের বাক রোধ করেছে দেশের ভালমন্দের একক শরিকানা নিয়েছে তথাকথিত দেশপ্রেমিক নেতারা। দেশের জনগণ তাদের নিকট অপাংক্তেয় হয়ে থেকেছে। তারা নিছক জনগণ এবং তাদের ভালমন্দ ও অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখবার ভার যেন শুধুমাত্র ঐসকল নেতাদের খেয়াল-খুশীর উপর নির্ভর করেছে। একাই শাশ্বত রূপ হয়ে দাঁড়িয়েছে পাকিস্তানী রাজনীতির সেই ১৯৪৭ সাল থেকে। ইস্কান্দার মির্জা, আইয়ুব-ইয়াহিয়া সকল নেতাই ঐ একই চরিত্রের অধিকারী। তারাও মাঝে মধ্যে গণতন্ত্রের বুলি কপচিয়েছেন আবার জনগণের কন্ঠরোধ করে দেশে স্বৈরতান্ত্রিক শাসন ও শোষণ চালিয়েছে জনগণের উপর। বর্তমান পাক প্রেসিডেন্ট ভুট্টোকেও আমরা এর ব্যতিক্রম দেখছিনা। ভুট্টোর কন্ঠেও গণতন্ত্রের সোচ্চার ধ্বনি শোনা যাচ্ছে। ভুট্টো নাকি তার দেশবাসীকে একটা গণতান্ত্রিক সংবিধান উপহার দেবেন। এ সংবিধান ভুট্টোর ইচ্ছামাফিক রচিত। তিনিও জনগণের মতামত বা ইচ্ছাকে কেয়ার করেন না। এ সংবিধান জনগণের ঘাড়ে তিনি চাপিয়ে দিতে দৃঢ়সংকল্প।
ভুট্টোর দেশে এখন রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা বিদ্যমান। জনগণ তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার অক্ষুন্ন রাখতে ঐক্যবদ্ধ। তারা আর ভুট্টোর ছিনিমিনি খেলায় ক্রীড়নক হতে চায় না। তারা তাদের পছন্দমত একটা সংবিধান চায়। তাই উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ, বেলুচিস্তান ও অন্যান্য অঞ্চলে জন অসন্তুষ্টি। জনগণ রুষ্ট। তারা তাদের অধিকার রক্ষার্থে অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছে। ভুট্টোর মাথাব্যথা আরো বেড়েছে। সে জনগণকে যে কোন উপায়ে বাগে আনতে সচেষ্ট। জনগণকে বিভ্রান্ত করবার জন্য প্রচারযন্ত্রগুলোকে ইচ্ছামত কাজে লাগাতে বদ্ধপরিকর। সংবাদপত্র, বেতার, টেলিভিশনের উপর কড়াকাড়িভাবে সেন্সরশীপ আরোপ করা হয়েছে। যেন শুধুমাত্র ভুট্টোর বুলিগুলোই জনগণের কাছে পৌঁছায়। বিরোধী দলীয় মতাদর্শ যা জনগণের আশা আকাঙ্ক্ষার প্রতিধ্বনি সেগুলো যেন প্রচারযন্ত্রগুলোর মাধ্যমে প্রচারিত না হয়। তাহলে ভুট্টো এমনিই হালে পানি পাচ্ছে না আরো তার অবস্থা টলটলায়মান হবে। তাই ভুট্টোর এই প্রতিরোধ ব্যবস্থা। সংবাদপত্র ও অন্যান্য প্রচারযন্ত্রগুলোর উপর কড়াকড়ি নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা।
এ সকল দৃষ্টান্তে মনে হয়, ভুট্টোর মুখের গণতন্ত্রের বুলি আর ধোপে টিকছেনা। জনগণ বুঝতে পেরেছে ভুট্টো নির্মিত সাংবিধানিক ফাঁস ভুট্টো সরকার তাদের গলায় পরিয়ে তাদের শ্বাসরোধ করতে চায়। এ কারণে, ভুট্টোও বোধহয় সতর্ক। তাই পাকিস্তানের শান্তিকামী জনগণের বাকশক্তিকে রুদ্ধ করতে ভুট্টোর এমন প্রতিরোধ ব্যবস্থা। অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে এটা দৃশ্যমান যে, ভুট্টোর রাজনীতি তথা পাকিস্তানের রাজনীতি পূর্বসুরীদের মত এবারেও একনায়কতন্ত্র বা স্বৈরতন্ত্রের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক