বাংলার বাণী
ঢাকা: ১৯শে জুন, মঙ্গলবার, ৪ঠা আষাঢ়, ১৩৮০
বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিন
বর্তমানে দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতির চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছে। যুদ্ধবিধ্বস্ত সমস্যা কণ্টকিত বাংলাদেশের উন্নতি, অগ্রগতি ও পুনর্গঠন এর ব্যাপারে অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা এবং অরাজকতার প্রতিপদে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করেছে। জনজীবন এতে বিপর্যস্ত ও নিরাপত্তাহীন হয়ে পড়েছে। দেশের সর্বত্র একটি ভয়াবহ অনিয়ম ও গোলযোগ দেখা দিচ্ছে। খুন, রাহাজানি, চুরি-ডাকাতি-ছিনতাই, গুপ্তহত্যায় দেশের আকাশ বাতাস কুলুষিত হয়ে উঠেছে।
এরই পরিপ্রেক্ষিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেন যে, সমাজে শান্তি ভঙ্গ কারি দুষ্কৃতিকারীদের সরকার মাথা তুলে দাঁড়াতে দেবেন না। আজ বিরোধী দমনে সরকার কৃত সংকল্প। গত রোববার সকালে সংসদ ভবনের প্রধানমন্ত্রীর সভাপতিত্বে আড়াই ঘন্টা ব্যাপী আওয়ামী লীগ সংসদীয় দলের অনুষ্ঠিত এক সভায় তিনি উক্ত ঘোষণা করেন।
সংসদীয় দলের বৈঠকে দেশে বিরাজমান আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হয়। বঙ্গবন্ধু এই সভায় উপস্থিত বিভিন্ন জেলার সংসদ সদস্যদের কাছ থেকে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির খোঁজখবর নেন। অতঃপর সকল সংসদ সদস্যকে প্রত্যেকের এলাকায় শান্তি ও আইন-শৃঙ্খলা নিশ্চিতকরণে আরো সক্রিয় হতে নির্দেশ দেন। তোদের গ্রামে গিয়ে দুষ্কৃতিকারীদের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তুলবার জন্য তিনি আহ্বান জানান। শৃঙ্খলা জনিত সুখ শান্তি ও নিরাপত্তা প্রত্যেকটা মানুষেরই কাম্য। পত্রিকান্তরে আজকের গ্রাম্য জীবনের চিত্র পাওয়া যায় তা এককথায় লোমহর্ষক। তবু বিপদের মোকাবিলা করার জন্য গ্রামবাসীদের মধ্যে সংঘবদ্ধভাবে রুখে দাঁড়াবার প্রবণতাও দেখা গেছে। তারা নিজেদের চেষ্টায়ও বুদ্ধিতে রাতের পাহারাদারের ইত্যাদির ব্যবস্থা করছে কোন কোন স্থানে। কিন্তু তাদের শক্তি ও চেষ্টা সীমিত। তাই অস্ত্রধারী দুষ্কৃতিকারীদের বাধা দেওয়া তাদের সাধ্যে কুলায় না। অবশেষে তাদের হতাশ হয়ে অত্যাচারের শিকার হতে হয়। আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস গ্রামে গিয়ে দুষ্কৃতিকারীদের দমনের পক্ষে জনমত গড়ে তোলার প্রস্তাবে গ্রামবাসীর তথা সমগ্র জনসাধারণ নতুন করে মনোবল ফিরে পাবেন। এ প্রসঙ্গে বলতে হয় শুধু দুষ্কৃতিকারী ও শান্তি ভঙ্গ কারীদের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তুললে সমস্যার সমাধান হবে না। দুষ্কৃতিকারী একটি-দুটি নয়। শত সহস্রা এবং তারা কোন কোন ক্ষেত্রে বেশ সুসংগঠিত। তাদেরও সর্বনাশের সংগঠনের মূলে আঘাত হানতে হবে এবং দৃষ্টান্তমূলক সাজা দিয়ে অন্যান্য অপরাধীদের মনে ত্রাসের সৃষ্টি করতে হবে। এছাড়াও খবরে জানা যায় যে বহু অস্ত্র বেআইনিভাবে এখনো বাইরে রয়েছে। সেগুলোরই অপব্যবহার সমাজবিরোধী গুন্ডারা করেছে। এই সকল অস্ত্র সংগ্রহের সঙ্গে সঙ্গে ঐসব অস্ত্রধারীদের কঠোর সাজা ব্যবস্থা করতেই হবে।
সর্বোপরি গ্রাম সর্বোচ্চ বাংলাদেশের মধ্যে যেকোন প্রকার জনমত গড়ে তুলতে হলে তাদের সহযোগিতার প্রশ্নটি সবচেয়ে বড় হলেও সেখানে সংসদ সদস্যদের দায়িত্ব ও কম নয়। কার বঙ্গবন্ধু তাদেরই প্রতি সরাসরি নির্দেশটি রেখেছেন। সংসদ সদস্যের গ্রামে গিয়ে গ্রামীণ জীবনের খোঁজখবর নেওয়া এবং তাদের সুখ ব্যবস্থার প্রতি লক্ষ্য রাখতে হবে। জনমত সৃষ্টিকারী এইসব কাজ এমনভাবে করতে হবে, যেন জনসাধারণ তাদের উপর আস্থা রাখতে পারে এবং তারা নিরাপত্তার আশ্বাস পায়। এরই প্রেক্ষিতে সংসদ সদস্যগণ ও যেন কোনো মূল্যে দেশে শান্তি ও শৃঙ্খলা নিশ্চিত করার জন্য তা প্রকাশ করে।
আইনশৃঙ্খলা জনিত পরিস্থিতির যে পরিমাণ অবনতি হয়েছে তার থেকে রেহাই পেতে গেলে প্রত্যেক কর্মীকে তাদের কাজের গুরুত্ব বুঝতে হবে এবং দূরদৃষ্টিসম্পন্ন হতে হবে। তা নইলে বঙ্গবন্ধুর এত বড় মানবিক আবেদন ব্যর্থ হয়ে যাবে। একথা সর্বাগ্রে বুঝতে হবে যে আমাদের স্বাধীনতার গৌরব দেশীয় ঐতিহ্যের মানব সভ্যতার পরিচয় ও আদর্শের বাস্তবায়ন আমাদেরই উপর নির্ভর করছে। অতএব আসুন আমরা সবাই সহযোগিতা ও উন্নতির মনোভাব নিয়ে যৌথভাবে পারস্পরিক সমঝোতার ভিত্তিতে কাজ করে যাই। একনিষ্ঠতা ও একতাই সাফল্যের মূল চাবিকাঠি।
ভারত-যুগোশ্লাভিয়া যুক্ত ইশতেহার
ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী সম্প্রতি তিনদিনের এক সফরে যুগোস্লাভিয়ায় গিয়েছিলেন। এরপর সেখান থেকে কানাডা অভিমুখে রওনা হয়ে গেছেন। যুগোস্লাভিয়া অবস্থানকালে প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী প্রেসিডেন্ট টিটোর সঙ্গে এক গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে মিলিত হন। এছাড়া শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী যুগোস্লাভ প্রধানমন্ত্রী মিঃ জামাল বিজেডিক এর সঙ্গে আলোচনা করেন। আলোচনা শেষে একটি যুক্ত ইশতেহার ও প্রকাশিত হয়েছে। ইশতেহারে উভয় দেশের মধ্যে বাণিজ্য অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে ভারত যুগোস্লাভ যৌথ উদ্যোগ গ্রহণের কথা ঘোষণা করেছে। আন্তর্জাতিক বাজারে পরস্পর সহযোগিতার ভিত্তিতে বাণিজ্য সম্প্রসারণের কোথাও ইশতেহারে বলা হয়েছে। যুগোস্লাভিয়া সিডেন্ট মার্শাল টিটো এশিয়ার স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য সকল প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে সস্তা বৃদ্ধির যে অভিমত পোষণ করেছেন ইশতেহারে সে কথা উল্লেখ করা হয়। ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী তার সম্মানে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে ভাষণ দিতে গিয়ে বলেছেন যে, সাম্রাজ্যবাদ ও উপনিবেশবাদ ও সকল প্রকার বর্ণবাদের বিরুদ্ধে ভারত সর্বদায় সোচ্চার এবং সকল মানবতাবিরোধী ঘটনাবলীর প্রবাদ কণ্ঠ। যুগোস্লাভিয়া ও ও এসকল হীন চক্রান্তের বিরুদ্ধে সর্বদা সোচ্চার কণ্ঠ। শ্রীমতি গান্ধী ভারত পাকিস্তানসহ উপমহাদেশের বিভিন্ন মানবিক সমস্যা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন এদিকে যুক্ত ইশতেহার আশা প্রকাশ করা হয়েছে যে বাংলাদেশ শীঘ্রই জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভ করতে সক্ষম হবে। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী বিগত ১৭ এপ্রিলের বাংলাদেশ ভারত যুদ্ধ ঘোষণার ব্যাখ্যা দান করেন এবং উপমহাদেশের মানবিক সমস্যাবলীর সমাধান ও এতদ এলাকা স্থায়ী শান্তি ও সহযোগিতার স্বার্থে আন্তরিক বাস্তবমুখী উদ্যোগ গ্রহণের কথা উল্লেখ করেন। প্রকাশিত ইশতেহারে আরো জানা গেছে যে স্থায়ী শান্তি ও সাহায্য-সহযোগিতার স্বার্থে ভারত যে প্রতিবেশীসুলভ সম্পর্ক গড়তে আগ্রহী তার জন্য যুগোস্লাভিয়া ভারতের প্রশংসা ও সমর্থন জানিয়েছেন। সর্বোপরি ইশতেহারে ১৯৬৭ সালে দখলকৃত আরব ভূখন্ড থেকে ইসরাইলি সৈন্য প্রত্যাহারের আহ্বান জানানো হয়েছে। বস্তুতপক্ষে ভারতের শান্তি ও প্রতিবেশীসুলভ সম্পর্ক গঠনের আগ্রহকে যুগোস্লাভিয়া যেমন স্বীকার করেছে তেমনি আমরাও নির্দ্বিধায় স্বীকার করি। উপমহাদেশে সত্যিকার অর্থে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠিত হোক এটা ভারতে ঐকান্তিক ইচ্ছা। আমরাও ভারতের সাথে যৌথ ঘোষণার মাধ্যমে এই উপমহাদেশের স্থায়ী শান্তি ও মানবিক সমস্যার সমাধানের কথা ব্যক্ত করে ছিলাম। বাংলাদেশের আন্তরিকতাও এ ব্যাপারে অবশ্য উল্লেখযোগ্য। কিন্তু পাকিস্তান পূর্বাপর তার অনাগ্রহ দেখে আসছে এবং উত্তেজনার সৃষ্টি করছে। যুগোস্লাভিয়া যে আশাবাদের কথা ও আন্তরিকতার মনোভাব প্রকাশ করেছে তাতে আমরা কৃতজ্ঞ। তারা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময়ও ঐকান্তিক সমর্থন জুগিয়েছিল। বিশ্ব বিবেক যুগোস্লাভিয়ার মত জাগ্রত হয়ে উঠুক এটাই আমাদের কামনা।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক