বাংলার বাণী
ঢাকা: ১৬ই জুন, শনিবার, ১লা আষাঢ়, ১৩৮০
উপমহাদেশীয় শান্তিতে আমরা বিশ্বাসী
জার্মান গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের উদ্দেশ্যে সম্প্রতি কয়েকজন আওয়ামী লীগ নেতা ঢাকা ত্যাগ করেছেন। দলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জনাব জিল্লুর রহমান। জি, ডি আরের উদ্দেশ্যে গমন এর পথে প্রতিনিধিদলটি কলকাতা বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকার দেন। সাক্ষাৎকার দলের নেতা জনাব জিল্লুর রহমান সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের উত্তরে বলেছেন- ‘যদি পাকিস্তানী শাসক চক্র আটক বাঙ্গালীদের বিচার করে তাহলে আমরাও যেসকল পাকিস্তানিদের আটক করে রেখেছি তাদের বিচার করব।’ ইলু রহমান সাহেবের উপরিউক্ত বক্তব্যে এটাই সুস্পষ্ট হয়েছে যে, পাকিস্তান বর্তমানে বাঙ্গালীদের বিচার করার প্রহসনের যে কথা ঘোষণা করেছে তার প্রেক্ষিতে বাংলাদেশের মতামত ও বলিষ্ঠ। বাংলাদেশ অত্যন্ত নমনীয় হয়ে আটক পাকিস্তানিদের প্রতি যে মানব সুলভ আচরণ করছে তা আর করবে না। তাদের কৃত অপরাধের যথার্থ বিচার হবেই। মূলত পাকিস্তান যদি উপমহাদেশে শান্তি ও নিরাপত্তা বিধানের নিশ্চয়তা থেকে দূরে সরে থাকে তাহলে বাংলাদেশের আর কিছু করণীয় থাকতে পারে না। বিশেষ করে যুদ্ধবন্দী ও আটক বাঙ্গালীদের ফেরত সংক্রান্ত ব্যাপার নিয়ে দু’দেশের মধ্যে যে সকল তিক্ততার সৃষ্টি দিনদিন পাকিস্তানের খামখেয়ালিতে বৃদ্ধি পাচ্ছে তার অবসানকল্পে বাংলাদেশের আগ্রহকে পাকিস্তান দুর্বলতা ভেবে নিয়ে টালবাহানা করছে। তারা সাম্প্রতিককালের নিরপরাধ বেসামরিক আটক বাঙ্গালীদের বিচার করার হুমকি প্রদর্শন করেছে। অথচ একটি অত্যন্ত সত্য কথা যে যুদ্ধকালীন সময়ে বাংলাদেশে পাকিস্তানিরা যে জঘন্য অন্যায় করেছে তার জন্যে যদি তাদেরকে অপরাধী সাব্যস্ত করা যায় তাহলে কেউ বাদ যেতে পারবে না। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ অত্যন্ত উদারতার পরিচয় দিয়ে মাত্র একশত পঁচানব্বই জন যুদ্ধাপরাধীকে বিচার করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। আর তাকে কেন্দ্র করে পাকিস্তান বাঙ্গালীদের বিচারের হুমকি দিয়েছে। তার হুমকির গোপন কথা হল বিনাবিচারে সমস্ত প্রকার বন্দিকে মুক্তি দেওয়া। কিন্তু এই দরকষাকষি যে আদৌ ফলপ্রসূ হবে না তা ভুট্টো সরকারের অনুধাবন করা উচিত। বাংলাদেশে যারা নির্বিচারে গণহত্যা চালিয়েছে এবং নারী ধর্ষণ শিশু হত্যা করেছে তাদের বিনা বিচারে ছেড়ে দেওয়া কোনদিন হবে না। জনাব জিল্লুর রহমানকে আটক বাঙ্গালীদের বিচার করার হুমকির জবাবে আটক পাকিস্তানিদের বিচার করার যে কথা বলেছেন তা মোটেই অযৌক্তিক নয়। উপমহাদেশের স্থায়ী শান্তির জন্য তাই আমরা আবার বলব পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষের এখনো বোধোদয় হবার সময় আছে এবং আটক বাঙ্গালীদের ফিরিয়ে দিয়ে বাংলাদেশের বাস্তবতার স্বীকার করে নিয়ে শান্তির পথে তারা পা বাড়াবেন।
ছাতক সিমেন্ট কারখানা বন্ধ
চুনাপাথরের অভাবে ছাতকের সিমেন্ট কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। অথচ এই অচলাবস্থা দূরকরণে কর্তৃপক্ষ নাকি কোনো ব্যবস্থা নেননি। ছাতকের সিমেন্টের কারখানা দেশে একমাত্র সিমেন্ট কারখানা। আসে কারখানার উৎপাদন যদি বন্ধ হয়ে যায় তবে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনের কাজের কি হাল হবে সেটা সহজেই অনুমেয়। অন্যদিকে জনগণকে কি পরিমান দুর্ভোগের সম্মুখীন হতে হবে এবং নির্মাণ কাজের ওপর নির্ভরশীল লক্ষ লক্ষ শ্রমিক পরিবারকে কোন সমস্যার অতল গহব্বরে ঢেলে দেওয়া হবে সেটাও যথার্থই ভাবার কারণ।
ছাতক সিমেন্ট কারখানা বাংলাদেশের একটি পুরনো কারখানা। এ কারখানায় উৎপাদিত সিমেন্ট দিয়ে গোটা দেশের চাহিদা মেটানোর মতো ব্যবস্থা হতে একসময় করা যেত। কিন্তু ঔপনিবেশিক শাসনামলে পাকিস্তানি শাসকরা বোধগম্য কারণেই এ কারখানাটিকে কোনদিনই স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে দেয়নি। তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানী সিমেন্টের একটি কায়েমি বাজার এখানে প্রতিষ্ঠা করেছিল। দেশ স্বাধীন হবার পর দেশের অন্যান্য শিল্প কারখানার সাথে সাথে এ কারখানাটিকে প্রভূত পরিমাণে উন্নয়ন সাধন করে দেশের চাহিদা পূরণের পক্ষে উপযোগী করে তোলা হবে বলে দেশবাসী আশা করছিলেন। কিন্তু প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে দেশবাসীর আশা যেমন নিরাশাযর আধারেতে হবার উপক্রম হয়েছে এক্ষেত্রে তার ব্যাতিক্রম হয়নি।
বর্তমানে সরকার বিদেশ থেকে সিমেন্ট আমদানি করছেন এবং তা দিয়ে দেশের চাহিদা পূরণের প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে। কিন্তু এত অধিক অধিক অর্থ ব্যয় না করে যদি সে টাকা দিয়ে চুনাপাথর আমদানি করা হয় তাহলে একদিকে বৈদেশিক মুদ্রা যেমন অপচয় এর হাত থেকে বাঁচবে তেমনভাবে সিমেন্টের আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে পারব।
ছাতক চুনাপাথর সমিতি ভারত থেকে সিমেন্টের বদলে চুনাপাথর আমদানি করার জন্য এর আগে যে আবেদন জানিয়েছিলেন কর্তৃপক্ষ সে ব্যাপারে দারুণ অবহেলা দেখানোর ফলে আজে কারখানাটি বন্ধ হতে বাধ্য হয়েছে। এমত অবস্থায় সে আবেদনটির প্রতীক কর্তৃপক্ষ যদি পুনরায় দৃষ্টিদান করেন এবং ভারত থেকে যথাশীঘ্র সম্ভব চুনাপাথর আমদানি করার ব্যবস্থা করেন তাহলে হয়তোবা এ কারখানাটিকে রক্ষা করা সম্ভব হতে পারে।
অকালকুষ্মাণ্ড যাতে না হয়
ঘটনাটি অভিনব। এমন ঘটনা সচরাচর ঘটে না। ঘটনাটি ঘটেছে রাজশাহীতে। সংবাদে প্রকাশ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডাক্তার অবাধ্য ছেলেকে শায়েস্তা করতে গেলে ছেলে বাবার কান কামড়ে ছিড়ে ফেলে। অধ্যাপক বর্তমানে হাসপাতলে রয়েছেন।
একেই বলে ঘোর কলিকাল। ছেলে বাবার কান কামড়ে ছিড়ে দেবে এমনটি বাস্তবে ঘটেছে কল্পনা করতেও গা শিউরে উঠে। যে বাপ মাথার ঘাম পায়ে ফেলে ছেলেকে মানুষ করার চেষ্টা করছেন তার কথায় ছেলে চটি গিয়ে এমন ও কাণ্ডটি করার পেছনে নিশ্চয়ই কারণ রয়েছে। আর সে কারণে সূত্র খুঁজতে হবে। ছেলে যদি অকালকুষ্মাণ্ড হয় তাহলে তো কোন কথাই নেই। এ ঘটনা থেকে সকলকেই ভাবতে হবে। ছেলে যাতে অকালকুষ্মাণ্ড না হয় সেদিকে অবশ্যই লক্ষ্য রাখতে হবে।
অধ্যাপক বাবার সঙ্গে ছেলের অভাবনীয় কারবারটির উপর কটাক্ষ না করে আমরা বলবো যে, আজকালকের উঠতি বয়সী ছেলেমেয়েরা স্বাভাবিকভাবে একটু স্বাধীনচেতা ও স্বাধীন তন্ত্রের অনুসারী। ছেলেমেয়েরা মহাবিদ্রোহের মত যেন আকাশ বাতাস ফুরে উঠতে চায়। উঠুক। তবে কতটুকু উঠবে এটাই হল আসল কথা।
ইংরেজীতে একটা কথা আছে- ‘স্পেয়ার দ্য রড স্পয়েল্ড দ্য চাইল্ড’ অর্থাৎ শাসনের চোখ রাঙ্গানিকে ঢেলে দিলেই ছেলে বকে যাবে। আজকাল যেন বাপ মারা এই নিয়মটি মানতে চান না। এর কারণ অবশ্য অনেক যে বাবা ছেলেকে বলেছেন দুর্নীতি করুনা সেই বাবাই পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষভাবে দুর্নীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট রয়েছেন। সুতরাং ছেলে বাবার কথা মানবে কেন।তাই কথার সঙ্গে কাজের সামঞ্জস্য রাখতে হবে। তবে সব সময় যে শাসন দন্ড উঠিয়ে রাখতে হবে এমন নয়। সদা সতর্ক দৃষ্টি অবশ্যই রাখতে হবে। ছেলে বা মেয়ে যদি একবার শাসনের বাইরে চলে যায় তখন আর তাকে সঠিক পথে আনা যায় না। লক্ষ্য রাখতে হবে ছেলে বা মেয়ে যাতে অকালকুষ্মাণ্ড পরিণত না হয়। অকালকুষ্মাণ্ড হলে যেমন পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হবে তেমনি ক্ষতিগ্রস্ত হবে সারা দেশ।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক