পঁয়তাল্লিশ সনে কম্যুনিস্ট পার্টি ও কৃষক সম্মেলন
কম্যুনিস্ট পার্টির নাম শুনেছিলাম নির্বাচনের আগের বছরেই—১৯৪৫ সালে। সে বছর আমি ক্লাস থ্রি-এর ছাত্র।
কম্যুনিস্টরা সে সময় নেত্রকোনায় একটা আলােড়ন সৃষ্টিকারী কাণ্ড ঘটিয়েছিল। তাদেরই উদ্যোগে ১৯৪৫ সালের এপ্রিল মাসে নেত্রকোনা শহর সংলগ্ন নাগরার মাঠে অনুষ্ঠিত হয়েছিল সারা ভারত কৃষক সম্মেলন। এ-রকম এলাহি কাণ্ড এই এলাকার মানুষ আগে কখনাে দেখবে দূরে থাক, কল্পনাও করতে পারেনি। লাখ খানেক মানুষের নাকি জমায়েত হয়েছিল সেই সম্মেলনে। আমাদের গ্রাম থেকে নয় মাইল দূরে ছিল সম্মেলন-স্থলটির অবস্থান। গ্রামের পাশের ডিস্ট্রিক্ট বাের্ডের সড়ক ধরে অজস্র মানুষ যাত্রা করেছিল—সে দৃশ্য এখনাে আমি চোখ বুজলে দেখতে পাই। আমার বাবাও সে-সম্মেলনে গিয়েছিলেন। আমিও বাবার সঙ্গে যাবার জন্যে বায়না ধরেছিলাম। কিন্তু যেতে পারিনি। আমাকে সভা-সমিতিতে নিয়ে যাবার ব্যাপারে বাবার অমিত উৎসাহ থাকলেও সেই সম্মেলনে নিয়ে যেতে রাজি হলেন না প্রচণ্ড ভীড়ের কথা ভেবে। আর ঠাকুরমা তাে কিছুতেই এই ভীড়ের মধ্যে আমাকে যেতে দেবেন না। এই নাতিটিকে নিয়ে তাঁর কী যে আদেখলাপনা ছিল, তা বলে বােঝাতে পারবাে না। তিনি নিজেই বলতেন, “তােকে
৪২
মাটিতে রাখি না পিপড়ায় কামড়াবে বলে, মাথায় রাখি না উকুনের ভয়ে। সব সময় রাখতে চাই বুকে আগলে, তাই তুই কি-না…।’ বলতে বলতে তাঁর দু’চোখ বেয়ে টপটপ করে জল ঝরে পড়তাে।
তাঁর এ-রকম আদিখ্যেতায় খুবই লজ্জা লাগতাে, রাগও হতাে কখনাে কখনাে। লজ্জা লাগতাে প্রতিবেশীদের সামনে এমন সৃষ্টি ছাড়া আদর দেখাতে থাকলে। প্রতিবেশীরা এ নিয়ে সুযােগ পেলেই আমাকে ক্ষেপাতাে।
রাগ হতাে আমাকে ইচ্ছেমতাে বাইরে না যেতে দিলে। বাইরে যাওয়ার নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে আমি যখন চোখা চোখা বাক্য প্রয়ােগ করতাম, তখন যুক্তিতে আমার সঙ্গে না পেরে ঠাকুরমা মুখ ঝামটা মেরে বলে উঠতেন, “তাের তাে আছে কেবল এই মুখটাই। মুখটা না থাকলে কবে যে তােকে শিয়াল-কুকুরে টেনে নিয়ে যেতাে!’
অথচ, আমাকে এই অকর্মণ্য মুখ-সর্বস্ব তারাই বানিয়েছেন, এ-কথা কিন্তু ঠাকুরমা কিংবা আমার গার্জেন পক্ষের কেউই স্বীকার করতেন না।
আমার কান্নাকাটিতে বাবার মন ভিজেছিল, শেষ পর্যন্ত আমাকে সঙ্গে নিয়েই সম্মেলনে যাবেন বলে ঠিক করে ফেলেছিলেন। কিন্তু ঠাকুরমাকে কিছুতেই রাজি করাতে পারলেন না, প্রচণ্ড চিকার ও হাত পা ছুঁড়ে আমার কান্নাকাটি কিংবা একবেলা অনশনেও কোনাে কাজ হলাে ।
সম্মেলন থেকে বাবা আমার জন্যে বেশ কিছু মুদ্রিত কাগজপত্র নিয়ে এসেছিলেন। সেসবের মধ্যে ছিল কমরেড মুজফফর আহমদ ও কমরেড মনি সিংহের ভাষণ। এগুলাে পড়ে তেমন কিছুই বুঝিনি, তবু পড়েছি প্রচণ্ড উৎসাহ নিয়ে। কমরেড’ শব্দটি নিয়ে আমি পড়েছিলাম খুবই বিপাকে। শুনলাম—কম্যুনিস্ট পার্টির সব লােককেই না-কি বলে কমরেড। কিন্তু কেন বলে, কথাটার আসল অর্থ কী? অন্য কাউকে কমরেড বলা যায় কি-না—আমার এসব প্রশ্নের সন্তোষজনক জবাব কারাে কাছেই পেলাম না।
যাই হােক, সম্মেলনের কাগজপত্র পড়ে এবং সম্মেলন প্রত্যাগতদের মুখে ওই অভূতপূর্ব জনসমাবেশটির বিমুগ্ধ বর্ণনা শুনে শুনে এর সম্পর্কে একটা ধারণা গড়ে নিতে ও নিজের চোখে -দেখতে পারার ও নিজের কানে না-শুনতে পারার ক্ষতিপূরণ করে নিতে চেষ্টা করেছি।
সবাই প্রথমে বলেছে, সম্মেলনের গেটে স্থাপিত বিরাট মূর্তিটির কথা। মূর্তিটি সম্পর্কে তাদের উচ্ছসিত বাক্যাবলি শুনতে শুনতে এক সময় আমার মনে হতে লাগলাে যে, আমি যেন নিজের চোখেই আমার সামনে মূর্তিটিকে মূর্ত হতে দেখছি। কাল্পনিক ঠাকুর-দেবতার মূর্তি দেখে গাঁয়ের মানুষ অভ্যস্ত, কিন্তু মূর্তি যে হতে পারে তাদেরই মতাে রক্তমাংসের মানুষের, তা তারা এর আগে কখনাে ভাবতে পারেনি। তা-ও আবার কৃষকের মূর্তি! দ্রলােকের চোখে কৃষক তাে নিতান্তই করুণার পাত্র; ছােটলােক, চাষা, গেঁয়ােভূত—এ-সবই হচ্ছে তার অভিধা। অথচ, সেই কৃষকেরই কি-না মূর্তি তৈরি হলাে এবং পেয়ে গেলাে ‘দেবতার অমর মহিমা।
পরে এই মূর্তিটি সম্পর্কে কমরেড সােমনাথ লাহিড়ীর লেখায় পড়েছি “প্রথমেই চোখে পড়ে এক বিরাট মাটির মূর্তি। সবল কৃষকের সংগ্রামশীল জীবনের রূপ। কোলে ধানের গুচ্ছ, বাঁ হাতে কাস্তে। উঁচু করে বুক ফুলিয়ে দাঁড়িয়েছে, জোরালাে পেশীগুলাে টান টান হয়ে ফেটে বেরিয়েছে, হাতের শৃঙ্খল ভেঙে পড়েছে। পায়ের শৃঙ্খলও যায় যায় । কৃষ্ণনগরের বিখ্যাত শিল্পী ফণি পাল এটি তৈরি করেছেন হৃদয় নামে এক হাজং কৃষক নেতার চেহারার অনুকরণে। যারা ঢােকে অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে। তারপর নানা জল্পনা-কল্পনা।”
৪৩
আমাদের গ্রাম থেকে যারা সম্মেলনে গিয়েছিল, তাদের কাছে পুরাে ব্যাপারটিই ছিল মহাবিস্ময়ের। সম্মেলন মানে, তাদের মনে হয়েছিল, এক বিরাট মেলা। আমাদের এলাকায় বারুণীর বা অষ্টমীর ঐতিহ্যবাহী মেলা ছাড়াও ফাল্গুন-চৈত্র মাসে এখানে-ওখানে অনেক মেলা বসতাে। গ্রামের একশ্রেণীর প্রভাবশালী মানুষই বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে এসব মেলার আয়ােজন করতাে, লােভনীয় ভাষায় প্রচারপত্র ছেপে দূর দূরান্তের মানুষদের আকর্ষণ করতাে। ওসব মেলায় নানা পণ্য সামগ্রীর পাশাপাশি থাকতাে আমােদ-প্রমােদের অঢেল ব্যবস্থা। তবে সবচেয়ে বেশি আকর্ষণ ছিল জুয়া খেলার। জুয়া খেলার পট বসিয়ে তা থেকে মােটা অঙ্কের দক্ষিণা আদায় করার দিকেই ওসব মেলার উদ্যোক্তাদের দৃষ্টি নিবদ্ধ থাকতাে। মেলায় জুয়া খেলে গাঁয়ের অনেক মানুষ সর্বস্বান্ত হয়ে যেতাে। তাই অনেক সময়ই সচেতন মানুষদের বিরােধিতার মােকাবেলাও এসব মেলার উদ্যোক্তাদের করতে হতাে।
সারা ভারত কৃষক সম্মেলনকে একটা বিরাট মেলার মতাে মনে হলেও শেষ পর্যন্ত মেলার সঙ্গে তাকে মেলানাে যাচ্ছিল না। জুয়া খেলার পট বসা তাে দূরের কথা, চেনাশােনা কোনাে পাক্কা জুয়াড়িকে আশপাশে কোথাও দেখা যাচ্ছিল না। জুয়াই যদি না থাকবে, তবে আর এটা মেলা হলাে কী করে? মেলার মতােই এখানে প্রচুর আমােদের ব্যবস্থা ছিল, কিন্তু সে-আমােদে নেশা ধরেনি, বরং নেশা ছুটিয়ে দেয়ার নানা উপকরণই ছিল তাতে। নেশা ধরানাের বদলে এমেলা চেয়েছিল কৃষককে তার নিজের পেশার প্রতি শ্রদ্ধাশীল করে তুলতে, কৃষককে যারা নানা ধরনের নেশায় বুদ করে রাখতে চায় তাদের প্রতি কৃষক-মনে পবিত্র ঘৃণার সঞ্চার ঘটাতে। সে-লক্ষ্যেই সম্মেলনের প্রধান ফটকে বসানাে হয়েছিল সংগ্রামী কৃষকের উন্নতশির মূর্তিটি। ওই মেলায় গান হয়েছিল, গান গেয়েছিলেন আমাদের এলাকারই বাউল গায়করা। কিন্তু গাঁয়ের কৃষকরা সবিস্ময়ে লক্ষ করলাে : বাউল মজিদ মিঞা আর রশিদউদ্দিন গ্রামের বাউল গানের আসরে যে ধরনের গান গেয়ে থাকেন, ওখানে তাে সে রকম গান করছেন না। ওখানে তাঁদের গাওয়া গান কাউকে উদাস করেনি, উদ্দীপিত করেছে। গায়ের বিচার গানের আসরে যেগায়করা হিন্দু-মুসলমানের ধর্মশাস্ত্রের নানা কথা নিয়ে নানা কূট প্রশ্ন তােলেন, ওখানে তারাই শাস্ত্র বিচার ছেড়ে কৃষকের জীবনের নানা সমস্যার বিচার করেছেন। তাঁদের গানে এসেছে মাত্র। দেড় বছর আগের পঞ্চাশের মন্বন্তরের টাটকা স্মৃতি; এসেছে কন্ট্রোল, রেশন আর কালাে বাজারের কথা; এসেছে জোতদার-মহাজনের শােষণ-অত্যাচারের প্রসঙ্গ। নেত্রকোনার মানুষের অতিপ্রিয় বাউল কবি মজিদ মিঞা গেয়েছেন—
হায়রে এমন বােকার দেশ ছিল…
স্ত্রী বলে, ওগাে স্বামী
উলঙ্গিনী আছি আমি,
শরম হতে ভালাে।
গরল আনাে না।
কিশােরগঞ্জের এক বাউল গায়কের এক নতুন রূপ উদ্ঘাটিত হলাে এই সম্মেলনে। সেগায়কের নাম অখিল ঠাকুর। অখিল ঠাকুরের জাগরণী গান কৃষকের একেবারে কানের ভিতর দিয়ে মরমে’ প্রবেশ করে তার তন্দ্রা ছুটিয়ে দিয়েছিল সেদিন।
আরেকজন কৃষক কবি নিবারণ পণ্ডিত তাে পুরাে সম্মেলনটাকেই মাতিয়ে রেখেছিলেন।
এই সম্মেলনের অন্যতম প্রধান ব্যবস্থাপক ছিলেন নেত্রকোনার বিখ্যাত সংগ্রামী গ্রাম বালির কৃষক নেতা মৌলবী আবদুল হান্নান। দীন-ই-ইসলামী শিক্ষায় শিক্ষিত ও মাদ্রাসা-পাস
৪৪
মৌলবী হয়েও আবদুল হান্নান যােগ দিয়েছিলেন সেই কম্যুনিস্ট পার্টিতে, যে-পার্টির বিরুদ্ধে প্রধান অভিযােগটিই হচ্ছে ধর্ম বিরােধিতার—বিশেষ করে ইসলাম-বিরােধিতার। হান্নান মৌলবী আজ নেই। তবে আমাদের সৌভাগ্য, তিনি আমাদের জন্য আমার জীবনে ক্যুনিস্ট পার্টি’ নামে একটি চমৎকার স্মৃতিকথা রেখে গিয়েছেন। সেই স্মৃতিকথায় নিবারণ পণ্ডিত সম্পর্কেও অনেক কথা আছে। নেত্রকোনায় যখন তৎকালীন সারা ভারতের কৃষকদের সম্মেলনের প্রস্তুতি চূড়ান্ত হয়ে গিয়েছিল, তখন শঙ্কিত ও ঈর্ষান্বিত হয়ে উঠেছিল অনেকেই। এদের মধ্যে কায়েমী স্বার্থবাদী জমিদার-তালুকদার-জোতদার-মহাজনরা এবং ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের অনুচররা যেমন ছিল, তেমনি ছিল জাতীয়তাবাদী কংগ্রেসীরাও। তারা নানা গুজব ছড়িয়ে এই সম্মেলন সম্পর্কে মানুষের মনে সন্দেহ ও আশঙ্কার জন্ম দিতে চাইছিল। কৃষক কবি নিবারণ পণ্ডিত এদের এই চক্রান্তের বিরুদ্ধে গান বাঁধলেন এবং এক মাস ধরে তাঁর দলবল নিয়ে নানা জায়গায় গিয়ে গাইলেন—
চলরে কিষাণ বাজিয়ে বিষাণ নিয়ে লাল নিশান সম্মেলনে চলরে,
ও ভাই হিন্দু-মুসলমান
শুনতে পেলাম এই শহরে কারা না-কি প্রচার করে
এই সভাতে গেলে পরে থাকবে না আর জান,
এই সভাতে বােমা ফেলতে আসতেছে জাপান
সম্মেলনে চলরে, ও ভাই হিন্দু-মুসলমান
সমস্ত চক্রান্ত ব্যর্থ করে দিয়ে সম্মেলনটি যখন সত্যি সত্যিই বাস্তব হয়ে উঠলাে, তখন এই নিবারণ পণ্ডিত পরিতৃপ্তির নিশ্বাস ফেললেন ও লক্ষ লােকের সামনে গাইলেন উদ্দীপক গান—
এক সাথে চল গড়ব মােরা রঙিন দুনিয়া
সবে মিলে থাকবাে যেথা বিভেদ ভুলিয়া বিভেদ ভুলিয়া।
হিন্দু-মুসলিম সবাই সমান সবার দুঃখ এক এক অবস্থায় ছােট বড় অনেক… নিবারণ পণ্ডিত, অখিল ঠাকুর, মজিদ মিঞা বা রশিদউদ্দিনের মতাে চারণ কৃষক কবিদের নতুন সুরের গান তাে সম্মেলনের কৃষকশ্রোতারা শুনলেনই, যেসব দ্রলােক’ গায়ক-কবিরা ভদ্রলােকী তকমা ছেড়ে কৃষকের কাতারে নেমে এসে কৃষকের সুখ-দুঃখের ভাগ নিতে চাইছিলেন তাঁদের গানও শুনলাে। শুনলাে বিনয় রায়, নির্মলেন্দু চৌধুরী, হেমাঙ্গ বিশ্বাস, হেনা দাস, জিতেন সেনদের মতাে গণশিল্পীর গান।
গাঁয়ের মানুষ সম্মেলনে এসে সংগ্রামী কৃষকের মূর্তি দেখলাে, শিকল ভাঙার গান শুনলাে, অধিকার সচেতন হওয়ার বক্তৃতা শুনে বুকের ভেতর অমিত তেজের উপস্থিতি অনুভব করলাে। এ-সবের সঙ্গে, এই প্রথম, প্রযুক্তি-বিজ্ঞানের একটা কৌতূহলােদ্দীপক আবিষ্কারও তারা প্রত্যক্ষ করলাে। মঞ্চের উপর দাঁড়িয়ে গায়ক গান গাইছেন অথবা বক্তা বক্তৃতা করছেন, আর প্রায় এক মাইল দূরে বসে আছে যে শ্রোতাটি সে-ও সেই গান কিংবা বক্তৃতা শুনতে পেয়েছে। এক লাখ লােকের প্রত্যেকের কানেই গান আর বক্তৃতার প্রতিটি কথা গিয়ে পৌঁছেছে। কী করে হলাে এমনটি? সেটাই তাে তাজ্জব ব্যাপার। কী একটা যন্ত্রের সামনের মুখ রেখে গায়করা গান গায় কিংবা বক্তারা বক্তৃতা দেয়, আর সভার ভেতরে এখানে-ওখানে খুঁটির মাথায় বেঁধে রাখা ইয়া বড়াে বড়াে অনেকগুলাে চোঙের ভেতর দিয়ে সবাই সেই গান বক্তৃতা স্পষ্ট শুনতে পায়।
৪৫
বাবাকে জিজ্ঞেস করলাম—ব্যাপারটি কী? বাবা বললেন—ওটাকে বলে লাউড স্পীকার। তারপর, কীভাবে এর সাহায্যে অনেক দূরে কথা চলে যায়, ‘মাইক’ বলে কাকে—এসব আমাকে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন।
মাইকে গান বক্তৃতা হয় না, এমন কোনাে অজপাড়াগাঁও সম্ভবত আজকের বাংলাদেশে খুঁজে পাওয়া যাবে না। কিন্তু ১৯৪৫ সনের আগে পাড়াগাঁয় তাে নয়ই, নেত্রকোনা শহরেও বােধ হয় কেউ মাইক দেখেনি। অন্তত নেত্রকোনার গ্রামাঞ্চলের মানুষ তাে কম্যুনিস্টদের কল্যাণেই এই শব্দ প্রসারণ যন্ত্রটির সঙ্গে পরিচিত হয়েছিল।
নাগরার মাঠে অনুষ্ঠিত পঁয়তাল্লিশের ‘সারা ভারত কৃষক সম্মেলন’-এর নানা প্রসঙ্গ লােকের মুখে মুখে ফিরেছে বহুকাল ধরে। ম্যাট্রিক পাস করে নেত্রকোনা কলেজে যখন ভর্তি হই, তখনই পরিচয় হয় হান্নান মৌলবী সাহেবের সঙ্গে। এরপর ১৯৬৪ সনে ময়মনসিংহ শহরে যখন কর্মজীবনে প্রবেশ করি (অর্থাৎ নাসিরাবাদ কলেজে অধ্যাপনার কাজে যােগ দিই) তখন মৌলবী সাহেবও এ শহরে এসেই আস্তানা গাড়েন। বুড়াে বয়সে এখানে ছােট্ট একটি বইয়ের দোকান খুলে বসেন। তাঁর স্নেহধন্য হওয়ার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। কম্যুনিস্ট কর্মীরূপে যেস্মৃতি সঞ্চয় করেছিলেন, তার ভাণ্ডার তিনি উন্মোচন করে দিয়েছিলেন আমার কাছে। তার স্মৃতি রােমন্থনে ঘুরে ফিরেই কৃষক সম্মেলনের প্রসঙ্গ উঠে আসতাে। পরে প্রমথ গুপ্ত, খােকা রায় ও মণি সিংহের বই পড়েও ওই সম্মেলন সম্পর্কে অনেক কথা জেনেছি।
দক্ষিণ ভারতের মালাবারে এ-সম্মেলনটি অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সরকারের নিষেধাজ্ঞার দরুন সেখানে তার অনুষ্ঠান করা সম্ভব হয়নি। তাই, শেষ পর্যন্ত তা স্থানান্তরিত হয়ে চলে আসে নেত্রকোনায়। নেত্রকোনার হাজং-কৃষকদের মধ্যে কম্যুনিস্ট পার্টির সংগঠন ছিল খুবই শক্তিশালী। এছাড়া হান্নান মৌলবীর বালি গ্রামটি তাে সে সময়ে হয়ে উঠেছিল ক্যুনিস্ট পার্টির দুর্ভেদ্য দুর্গ। মুসলমান কৃষকরাই ছিল সে-দুর্গের অকুতােভয় রক্ষী।
নেত্রকোনায় সম্মেলন অনুষ্ঠানে হান্নান মৌলবীরই ছিল সবচেয়ে বেশি উৎসাহ। কলকাতায় প্রাদেশিক নেতাদের কাছে তিনি অঙ্গীকার করে এসেছিলেন যে সম্মেলনে লাখ লােকের সমাবেশ করা হবে, সম্মেলনের প্যান্ডেল তৈরির জন্য যতাে বাঁশ লাগে তার যােগান দেয়া হবে।
হান্নান মৌলবী তাঁর কৃষক সহকর্মীদের নিয়ে সব অঙ্গীকার অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছিলেন।
এই বিশাল সম্মেলনের মূল সভাপতি ছিলেন কমরেড মুজফফর আহমদ ও অভ্যর্থনা কমিটির সভাপতি ছিলেন কমরেড মণি সিংহ। তেত্রিশ বছর জেল খেটে মাত্র তিন দিন আগে বেরিয়ে এসেছিলেন, যে সত্তর বছরের বৃদ্ধ পাঞ্জাবী নেতা, সেই বাবা কেশর সিং উত্তোলন করেছিলেন সম্মেলনের পতাকা। আরাকানের বিখ্যাত নেতা উপিনাৰ্য ডিহার, মণিপুরের ইরাবত সিংসহ উপমহাদেশের অনেক কমুনিস্ট নেতাই সম্মেলনে বক্তৃতা করেছিলেন। বাঙালি নেতাদের মধ্যে ভবানী সেন আর বঙ্কিম মুখার্জির বক্তৃতার প্রশংসা বহুকাল ধরে লােকের মুখে মুখে ফিরেছে।
এ-রকম একটা বিরাট সম্মেলনের অনুষ্ঠান করে কম্যুনিস্টরা আমাদের এলাকায় আলােড়ন সৃষ্টি করে ফেলেছিলেন ঠিকই, কিন্তু ব্যাপক জনসমর্থিত পার্টি যে গড়ে তুলতে পারেননি তা বােঝা গেলাে পরের বছরের ইলেকশনেই।
Reference: পাকিস্তানের জন্মমৃত্যু-দর্শন – যতীন সরকার