বাংলার বাণী
২৫শে জুলাই, বুধবার, ১৯৭৩, ৯ই শ্রাবণ, ১৩৮০ বঙ্গাব্দ
বিশ্ব যুব সম্মেলনে যোগদানের পথে বাংলাদেশ
আগামী ২৮শে জুলাই বিশ্ব যুব সম্মেলন অনুষ্ঠিত হতে চলেছে। গণতান্ত্রিক রিপাবলিক অব জার্মানীর রাজধানী বার্লিনে এ সম্মেলনের উদ্বোধন হবে। সাত দিনব্যাপী সম্মেলনের কাজ চলবে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ থেকে আজ পঁচাশি জনের একটি যুব প্রতিনিধি দল বিশ্ব যুব সম্মেলনে যোগ দেবার জন্যে ঢাকা ত্যাগ করেছেন। প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব করছেন আওয়ামী যুবলীগের প্রেসিডিয়ামের চেয়ারম্যান শেখ ফজলুল হক মনি। প্রতিনিধি দলের সঙ্গে দু’জন বিশিষ্ট নেতাও বিশেষ আমন্ত্রণক্রমে বার্লিন যুব সম্মেলনে যোগদান করেছেন। এরা হলেন বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির প্রধান শ্রী মনি সিং ও স্বাধীনতা যুদ্ধের অধিনায়ক এবং বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রী পরিষদের সদস্য জেনারেল আতাউল গণি ওসমানী। এছাড়া দেশের বিভিন্ন প্রগতিশীল রাজনৈতিক ও ছাত্র সংগঠনের পক্ষ থেকে মনোনীত প্রতিনিধিবৃন্দ সম্মেলনে যোগদান করছেন। বার্লিনে অনুষ্ঠিত এই বিশ্ব যুব সম্মেলনের গুরুত্ব অপরিসীম। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আগত প্রগতিশীল ছাত্র-যুবক এই সম্মেলনের যোগদান করবেন। সম্মেলনের প্রধান উদ্দেশ্য হবে বিশ্বের সকল সাম্রাজ্যবাদ, উপনিবেশবাদ ও বর্ণবাদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তোলা। বিশ্বের সকল প্রগতিশীল যুব প্রতিনিধিদের শ্লোগান হবে সাম্রাজ্যবাদ ধ্বংস হোক—বিশ্ব-শান্তি সংরক্ষিত হোক। সাম্রাজ্যবাদ, উপনিবেশবাদ ও বর্ণবাদের বিরুদ্ধে একমনা যুবকদের সংহতি ঘোষণার এই আন্তর্জাতিক সম্মেলন বিশ্বব্যাপী যে আলোড়ন সৃষ্টি করবে আমরা বিশ্বাস করি তাতে ঐ সকল ঘৃণ্য শক্তির ভিত অনেকাংশে কেঁপে উঠবে। সাম্রাজ্যবাদের ঘৃণ্য ছোবল দিন দিন প্রশমিত হতে চলেছে। বিশেষ করে বিশ্ব যুব সম্মেলনের সূচনাপর্ব থেকে সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে যে আন্দোলন দানা বেঁধে উঠেছে তার জন্যেই ঐ ঘৃণ্য শক্তির আস্ফালন অনেকখানি স্তিমিত হয়ে এসেছে। আগামী বিশ্বের প্রাণশক্তি মূলতঃ যুব সমাজ। তাদের প্রগতিশীল নেতৃত্বই একমাত্র বিশ্বের শান্তি ও প্রগতি নিশ্চিত করতে পারে। উল্লেখযোগ্য, এটাই প্রথম দেশের সকল প্রগতিশীল রাজনৈতিক ও ছাত্র-যুবদল একটি আন্তরিক শ্রদ্ধা ও সমঝোতা নিয়ে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী ঐক্যবদ্ধ শ্লোগানের প্রেক্ষিতে সম্মেলনে যোগদান করতে চলেছেন। এ কারণে জাতীয় ভিত্তিতেও এর গুরুত্ব অপরিসীম। বাংলাদেশের মানুষ বিভিন্ন সময় লাওস, কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকা সহ সকল স্বাধিকারকামী মানুষের সংগ্রামের সঙ্গে সংহতি ঘোষণা করে এসেছে। আমাদের জাতীয় স্বাধীনতা অর্জনের সংগ্রামের কালেও আমরা বিশ্বের বিভিন্ন সংগ্রামরত জাতির মরণপণ সংগ্রামের স্বপক্ষে সংহতি ঘোষণা করেছি। সাম্রাজ্যবাদী শক্তি যে কি নিদারুণ এবং বর্বর তা বাংলাদেশের মানুষ ত্রিশ লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে উপলব্ধি করেছে। স্বাধীনতাকামী মানুষের উপর সাম্রাজ্যবাদী শক্তি যে কি জঘন্য পশু মনোবৃত্তি নিয়ে নিজেদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত করে তা কারো অজানা নেই। সোভিয়েত ইউনিয়নের স্বাধীনতা লাভের মধ্য দিয়ে বিশ্বে যে নতুন সমাজ গঠনের আহ্বান এসেছে তার থেকেই আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সমাজতন্ত্রের জয়যাত্রা শুরু। আর এই জয়যাত্রার কারণেই বিশ্বের সকল সাম্রাজ্যবাদী-উপনিবেশবাদী শক্তি তাদের লোলুপ জিহ্বা দিন দিন সংবরণ করতে বাধ্য হচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে আরো সংঘবদ্ধ ও দৃঢ় হচ্ছে আন্তর্জাতিক মেহনতি মানুষের মুক্তির দাবী। বিশ্ব যুব সম্মেলনে মানবতার জয়গান গাওয়া হবে। বিশ্বশান্তির নিশ্চয়তার জন্যে ঐক্যবদ্ধ আওয়াজ তোলা হবে। বাংলাদেশের যুব প্রতিনিধি দলের মাধ্যমে বাংলাদেশও ঐ ঐক্যবদ্ধ আওয়াজের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করবে। আমরা আশা করছি—আন্তর্জাতিক যুব সম্মেলনে যোগদানকারী প্রতিনিধিদল বাংলাদেশের ঐতিহাসিক বীরত্বপূর্ণ স্বাধীনতা সংগ্রামের কথা ও দেশের নেতার তুলনাহীন নেতৃত্বের কথা সম্মেলনে তুলে ধরবেন। আন্তর্জাতিক যুব সম্মেলন সার্থক হোক এটাই আমাদের কামনা।
ঢাকা-হ্যানয় যুক্ত ইশতেহার
ভিয়েতনামী সাধারণ মানুষের পক্ষ থেকে ভিয়েতনাম গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী নগুয়েন দুয়েত্রিন বাংলাদেশের জনগণ ও সরকারের প্রতি আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন। কারণ অতীতে বাংলাদেশ ভিয়েতনামী জনগণের জাতীয় স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের সংগ্রামে সমর্থন দিয়েছিলো এবং বর্তমানেও ভিয়েতনাম সংক্রান্ত প্যারিস চুক্তি বাস্তবায়নের সংগ্রামে বাংলাদেশ তার দৃঢ় সমর্থন দান অব্যাহত রয়েছে। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডক্টর কামাল হোসেনের তিন দিনব্যাপী উত্তর ভিয়েতনাম সফর শেষে গত পরশু ঢাকা এবং হ্যানয় থেকে একই সঙ্গে প্রকাশিত এক যুক্ত ইশতেহারে বাংলাদেশ ও উত্তর ভিয়েতনাম বিশ্বব্যাপী সাম্রাজ্যবাদ, উপনিবেশবাদ, নয়া উপনিবেশবাদ ও বর্ণবৈষম্য বিরোধী সংগ্রামে শান্তি ও জাতীয় মুক্তির শক্তিগুলোর সঙ্গে সুদৃঢ় সংহতি ঘোষণা করা হয়েছে। ডক্টর কামাল হোসেন তাঁর এবারের এই বন্ধুত্বপূর্ণ সফরকে ভিয়েতনামের বীর জনতার গভীর ঐক্যবোধ ও প্রশংসামূলক মনোভাবের প্রতীক বলে ঘোষণা করেছেন। যুক্ত বিবৃতিতে বাংলাদেশ ও ভিয়েতনামের মধ্যে সহযোগিতামূলক সম্পর্ক গড়ে তোলার জন্যে বিভিন্ন ব্যবস্থা গ্রহণ সম্পর্কে দুই পক্ষ মতামত বিনিময় করেছেন। সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে ভিয়েতনামের বীর জনতা এক রক্তাপ্লুত সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়ে আজ বিশ্বের বুকে এক নতুন ইতিহাস রচনা করেছেন। বাংলাদেশ ও উত্তর ভিয়েতনামের সংহতিকে তাই আমরা অভিনন্দন জানাই। এবং আমরা আশা করি, সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সংগ্রামে এই দু’টি দেশ ঐক্যবদ্ধ থাকবে। বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায়ও এ দু’টি দেশ অনন্য ভূমিকা পালন করবে। ভিয়েতনাম গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলাদেশের জনগণের সুখী ও সমৃদ্ধিশালী জীবন কামনা করেছেন। ঐদিকে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ভিয়েতনামী জনগণের আন্তরিকতার জন্যে গভীর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন। ঢাকা-হ্যানয় যুক্ত বিবৃতিতে দু্ই দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদ্বয়ই বিশ্বের সকল জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানিয়েছেন এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে শান্তি প্রতিষ্ঠায় আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। এই দু’টি সংগ্রামী দেশের ঐক্য বিশ্বের প্রতিটি শান্তিবাদী দেশকেই উল্লসিত করবে তাতে কোন দ্বিমত প্রকাশের অবকাশ নেই। আমরাও চাই, যেখানেই শান্তির সংগ্রাম, সেখানেই যেন বাংলাদেশ এবং ভিয়েতনাম পাশাপাশি থেকে সাম্রাজ্যবাদ, উপনিবেশবাদ এবং বর্ণবিদ্বেষের কবর রচনা করতে সক্ষম হয়।
সফল হোক এ অভিযান
রাজধানী ঢাকায় কার্ফু দিয়ে তল্লাশী অভিযান চালানো শুরু হয়েছে। এবং গত সোমবার ও গতকাল মঙ্গলবার পরিচালিত এ অভিযান বেশ সফলতা লাভ করেছে। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, অভিযানের প্রথম দিনে অর্থাৎ গত সোমবার নিউমার্কেট এবং মোহাম্মদপুর এলাকায় কার্ফু দিয়ে তল্লাশী চালানো হয়েছিলো। সরকারী নিউমার্কেটে অভিযান চালিয়ে পুলিশ সেখানকার ৪৩১টি দোকানের মধ্যে ৪১০টি তালা বন্ধ করে দেন। তালাবন্ধকৃত দোকানগুলো গত ৬ বছর ধরে ভাড়া শোধ করেনি এবং এই বকেয়া পাওনার পরিমাণ ৩৪ লাখ টাকার মতো।
মোহাম্মদপুর এলাকায় তল্লাশী অভিযানের প্রথম দিনে ১২টি বেআইনী দখল করা বাড়ী উদ্ধার এবং ৩৭ হাজার টাকা বকেয়া আদায় করা সম্ভব হয়েছে। সেনাবাহিনীর তদারকিতে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো এই এলাকায় বকেয়া পাওনা পরিশোধ না করার জন্যে ৪২টি বাড়ীর পানি সরবরাহ, ৫৭টি বাড়ীর বিজলী সরবরাহ এবং ২৭টি বাড়ীর টেলিফোন কানেকশন কেটে দিয়েছেন। অন্যদিকে ভুয়া রেশন কার্ড সহ সকল রেশন কার্ড বাতিল করে দিয়ে এই এলাকায় ২৫ হাজার নতুন রেশন কার্ডও ইস্যু করা হয়েছে বলে জানা গেছে।
এই তল্লাশী অভিযানের প্রতি জনগণ স্বতঃস্ফূর্ত অভিনন্দন জানিয়েছেন। আইন প্রয়োগকারী সংস্থা বাড়ী বাড়ী গিয়ে পরিবারের সকল লোকের উপস্থিতিতে নতুন রেশন কার্ড ইস্যু করায় একদিকে ভুয়া রেশন কার্ড যেমন আপনাআপনিই বাতিল হয়ে গেলো, ঠিক তেমনি যাঁদের রেশন কার্ড ছিলোনা তাঁরাও রেশন কার্ড করাতে পারলেন এবং অহেতুক ঝামেলার হাত থেকে বাঁচতে পারলেন।
স্বাধীনতার পর খালি বাড়ী তথা পরিত্যক্ত বাড়ী নিয়ে যেন একটা হরিলুট কারবার চলছিলো। সরকার দীর্ঘদিন ধরে বেআইনী দখলকারদের বাড়ী খালি করে দেবার জন্যে অনুরোধ উপরোধ জানানো সত্ত্বেও অনেকেই যেন কান দেবারই প্রয়োজনীয়তা বোধ করেননি।
টেলিফোন, পানি এবং বিজলী ভোগ করা হয়েছে, অথচ বিলটি পরিশোধের কোন উদ্যোগ নেই। সরকারী মহল থেকে বার বার অনুরোধ উপরোধ নির্দেশ দেয়া সত্ত্বেও সেটা শোনবার প্রয়োজনীয়তা অনেকেই যেন উপলব্ধি করতে পারেননি। তাই সেনাবাহিনী ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর তৎপরতা তথা লাইন কেটে দেয়ায় অনেকে হয়তো দুর্ভোগের সম্মুখীন হলেও এটার জন্যে কিন্তু তারাই সরকারকে বাধ্য করেছেন। কাজেই দুর্ভোগটা এখন তাদের ললাট লিখন নয়—বরং নিজেদেরই আমন্ত্রণে টেনে আনা।
গত সোমবার যে তল্লাশী অভিযান চালানো শুরু হয়েছে, তার দু’দিনের সাফল্যে আমরা খুশী, কিন্তু চমৎকৃত নই—কেননা আমরা শেষাবধি এই তল্লাশীর সার্বিক সাফল্য কামনা করি।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক