বাংলার বাণী
২৩শে জুলাই, সোমবার, ১৯৭৩, ৭ই শ্রাবণ, ১৩৮০ বঙ্গাব্দ
সীমান্তের ওপারে নয়া প্রজাতন্ত্র, ভুট্টো উদ্বিগ্ন
রাজা জহির শাহ সিংহাসনচ্যূত, নবঘোষিত আফগানিস্তান প্রজাতন্ত্রের ক্ষমতা এখন প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী সর্দার দাউদ খানের করায়ত্ত। গত সতেরোই জুলাই অভ্যুত্থান সংঘটিত হবার পর থেকে সেখানকার রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্বন্ধে নানা খবর আসছে। ক্ষমতা দখলের অব্যবহিত পর সর্দার দাউদ খান এক বেতার ভাষণে বলেছিলেন, এতদিন গণতন্ত্রের নামে যে ভাঁওতাবাজী চলছিলো, তার অবসানই অভ্যুত্থানের মূল লক্ষ্য। আফগানিস্তানের রাজনৈতিক অবস্থা কোন্ দিকে মোড় নেয়, সেখানকার জনসাধারণের স্বার্থ নতুন ক্ষমতাপ্রাপ্ত সরকারের দ্বারা কতটুকু রক্ষিত হয় তা ভবিষ্যতই বলতে পারে কিন্তু আফগানিস্তানের এই অভ্যুত্থান তার প্রতিবেশী রাষ্ট্র পাকিস্তানে যে প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে তা সবিশেষ উল্লেখযোগ্য।
পাকিস্তান থেকে গার্ডিয়ান পত্রিকার সংবাদদাতা খবর পাঠিয়েছেন যে, পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলী ভুট্টো আফগানিস্তানে রাজতন্ত্র উচ্ছেদে বেশ উদ্বিগ্ন। পাকিস্তানের পররাষ্ট্র দফতর এখন পর্যন্ত মুখ না খুললেও অবস্থাটা যে তাদের কাছে খুব একটা ভালো ঠেকছে না এটা তাদের আচার আচরণে বেশ স্পষ্ট। আফগানিস্তানে এই অভ্যুত্থানের পর চারদিন যেতে না যেতেই পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির প্রধান খান আবদুল ওয়ালী খান দাবী তুলেছে, বেলুচিস্তান এবং উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশকে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন দেয়া হোক। তিনি পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলে বলেন, এই দুই প্রদেশের জনসাধারণের শাসনতান্ত্রিক অধিকার অগ্রাহ্য করা হয়েছে।
খান আবদুল ওয়ালী খানের এ দাবী কিছু নতুন নয়। পাকিস্তানের জন্যে পরবর্তীকাল থেকেই পাখতুন এবং বেলুচিরা তাদের স্বায়ত্তশাসনের দাবী জানিয়ে আসছিলো। আফগান শাসকদের সহানুভূতি বরাবর এই স্বাধিকারকামী জনতার স্বপক্ষে ছিলো। সর্দার দাউদ খান যখন আফগানিস্তানের প্রধানমন্ত্রী তখন আফগানদের সমর্থন অধিকতর সোচ্চার রূপ লাভ করে। আজ এত বৎসর পর আবার যখন সেই সর্দার দাউদ খান আফগানিস্তানের পূর্ণ ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত তখন স্বাভাবিকভাবেই ওয়ালী খানের বিবৃতি দিয়ে নতুন করে পাখতুন-বেলুচদের স্বায়ত্তশাসনের দাবী বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা হচ্ছে।
আরো একটা ব্যাপার যা পাকিস্তানী শাসক সম্প্রদায়, তার পশ্চিম এশীয় মিত্রবর্গ এবং এদের যৌথ মুরুব্বী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে আফগানিস্তানের রাজনীতির পালাবদলে চিন্তিত করে তুলছে। ইরান যদিও জলঘোলা না করে নয়া আফগান সরকারকে বৈধ সরকার হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে তবুও সর্দার দাউদ খানের জোটনিরপেক্ষ নীতি অনুসরণের সোচ্চার ঘোষণা ইরানের ইদানীংকালের বিপুল রণসজ্জা প্রস্তুতির প্রতি একটা প্রবল ঝাঁকুনিস্বরূপ। রাজতন্ত্রী আফগানিস্তানও অবশ্য জোটনিরপেক্ষ নীতি অনুসরণ করে আসছিলো কিন্তু তা তেমন সক্রিয় ছিলো না যতটা নয়া প্রজাতন্ত্রের ভবিষ্যত নীতিতে প্রতিফলিত হবে বলে অনুভূত হচ্ছে। শঙ্কিত তাই ভুট্টো, চিন্তিত পশ্চিম এশিয়ায় নতুন করে সংঘবদ্ধ হওয়া নয়া ষড়যন্ত্রকারী গোষ্ঠী।
বিপদে বন্ধুর পরিচয়
বিপদের সময় যে সাহায্য করে সেই তো প্রকৃত বন্ধু—এটি একটি পরীক্ষিত সত্য এবং এর সত্যাসত্য যাচাইয়ের কোন অপেক্ষা রাখে না। বাংলাদেশের সঙ্গে সোভিয়েত ইউনিয়নের বন্ধুত্বও যে নিখাদ এবং নির্ভেজাল তাতে সন্দেহ পোষণের কোন সঙ্গত কারণ নেই। কারণ, বিগত একাত্তর সালে যখন সমগ্র বাংলাদেশের বুকে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী নির্বিচারে নিরীহ মানুষ নিধন অভিযান চালিয়েছিলো তখন নৈতিক এবং মানবিক দিক বিবেচনা করে সোভিয়েত ইউনিয়ন পাকিস্তানী নারকীয় বর্বরতার বিরুদ্ধে নিন্দা বাক্য উচ্চারণ করেছিলো। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে সোভিয়েত ইউনিয়ন সার্বিক সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়ে আমাদের সঙ্গে গভীর বন্ধুত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলো। সোভিয়েত ইউনিয়নের সাহায্য ও সহযোগিতা ব্যতিরেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন ত্বরান্বিত হতো কিনা, তাও আজ ভেবে দেখার বিষয়। মোদ্দা কথা, বাংলাদেশের ঘোর দুর্দিনে সোভিয়েত ইউনিয়ন পরম বন্ধুর বেশে আমাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলো। আমাদের নিদারুণ দুঃখ ও চরম বিপদের দিনে বন্ধুসুলভ মনোভাব নিয়ে এগিয়ে এসে যে সাহায্য করেছে, তা শুধু মানবিক কারণে নয়, নৈতিক ও রাজনৈতিক কারণেও পৃথিবীর ইতিহাসে এক উজ্জ্বলতম দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। মুক্তিযুদ্ধের উত্তাল দিনগুলোতে যেমন, ঠিক তেমনি স্বাধীনতা পরবর্তী পুনর্গঠনের কালেও বাংলাদেশের প্রতি সোভিয়েত ইউনিয়নের সহযোগিতামূলক মনোভঙ্গিটি অব্যাহত রয়েছে। তাই দেখি, বাংলাদেশের খাদ্যাভাব সোভিয়েত ইউনিয়নকেও বিচলিত করে এবং বাংলাদেশের মানুষ যাতে না খেয়ে মৃত্যুবরণ না করে সে জন্যে সোভিয়েত ইউনিয়ন আমেরিকা থেকে নিজেদের জন্যে যে গম কিনেছে তা থেকে দুই লক্ষ টন গম বাংলাদেশকে সদিচ্ছার প্রতীকস্বরূপ দেবে বলে ঘোষণা করেছে। বাংলাদেশ সরকারকে ইতিমধ্যেই জানানো হয়েছে যে, আগামী সেপ্টেম্বর মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহের মধ্যে সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রদত্ত গমের সরবরাহ সম্পূর্ণ হবে। প্রকাশিত সংবাদে জানা গেছে, তের হাজার টন গমের একটি জাহাজ আগামী ২৬শে জুলাই চট্টগ্রাম বন্দরে এসে পৌঁছুবে। খাদ্যমন্ত্রী ফণীভূষণ মজুমদার আনুষ্ঠানিকভাবে এ গম গ্রহণ করবেন। এরপর আরো দু’টি গমবাহী জাহাজ আসবে। দ্বিতীয়টি ৩রা আগস্ট ষোল হাজার টন গম নিয়ে আসবে এবং তৃতীয় জাহাজটি এগারো হাজার টন গম নিয়ে আগামী ১৫ই আগস্ট চট্টগ্রাম বন্দরে এসে পৌঁছুবে। পুরো দুই লক্ষ টন গম সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যেই বাংলাদেশে এসে পৌঁছুবে বলে আশা করা হচ্ছে। সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রদত্ত এই দুই লক্ষ টন গম বাংলাদেশের প্রভূত উপকার সাধিত করবে। বাংলাদেশ এবার আমেরিকা এবং কানাডা থেকে খাদ্য ক্রয় করতে সক্ষম হয়নি। চীন এবং রাশিয়াই এই দু’টি দেশ থেকে বিপুল পরিমাণ গম কিনে নিয়েছে। মানবিক দিক থেকে দেখতে গেলে সোভিয়েত ইউনিয়ন আমেরিকা থেকে গম কিনে এবং তা থেকে বাংলাদেশকে দুই লক্ষ টন গম দেয়াতে পরীক্ষিত বন্ধুত্বের একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত নতুন করে স্থাপন করতে সক্ষম হলো। বাংলাদেশ-সোভিয়েত মৈত্রী বন্ধন যে কতো সুদৃঢ় তারই প্রমাণ হিসেবে এই গম প্রদানের ঘটনাটি একেবারে অনুল্লেখ্য নয়। গত বছর ভারত বাংলাদেশকে সাড়ে সাত লাখ টন খাদ্যশস্য দিয়েছিলো। শুধু মুক্তিযুদ্ধে সাহায্য নয়, ভারত আমাদের পুনর্গঠন কাজেও অব্যাহত গতিতে সাহায্য করে যাচ্ছে। বাংলাদেশের পরম বন্ধু হিসেবে ভারত এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের নাম কোন দিন মুছে যাবে না, কোনদিন মুছে যাবার নয়। খাদ্য সমস্যা আজ বাংলাদেশের একটি অন্যতম প্রধান সমস্যা। এই সংকট কাটিয়ে উঠার জন্যে সরকারীভাবে নানা রকম চেষ্টা করা হচ্ছে। আমাদের বন্ধুদেশগুলো থেকেও আমরা সাড়া পাচ্ছি। বিশেষ করে পরীক্ষিত বন্ধুদেশগুলোর মধ্যে সোভিয়েত ইউনিয়নের অবদান আমরা কখনো ভুলবো না।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক