আলতাফ মাহমুদ
ফেব্রুয়ারি মাস এলেই চারিদিকে বেজে ওঠে একটি গান‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানাে। আর এই গানের সাথে সাথেই অনেকের মনে ভেসে আসে গানটির সুরকার শহীদ আলতাফ মাহমুদের নাম। ১৯৩৩ সালের ২৩ ডিসেম্বর, বরিশাল জেলার মুলাদি উপজেলার পাতারচর গ্রামে তিনি জন্ম নেন। পারিবারিকভাবে দেওয়া নাম হলাে এ. এন. এম. আলতাফ আলী। দাদা আল মাহমুদের উপাধি নিয়ে নিজেই নিজের নাম ‘আলতাফ মাহমুদ রাখেন। ছােটবেলা থেকেই গান ছিল তার ধ্যান-জ্ঞান। অসম্ভব সুরেলা কণ্ঠের অধিকারী ছিলেন। দরাজ গলায় মধুর সুরে যখন কোরান পাঠ করতেন, সকলে মুগ্ধ হয়ে শুনত আর ভাবত, বড় হয়ে এ ছেলে একজন বড় কৃারী হবে। বাড়ির সামনে বেঞ্চিতে বসে ঘন্টার পর ঘণ্টা গান গাইতেন তিনি। আর সে গানে মুগ্ধ হতাে পরিবারের লােকজন, সহপাঠীরা থেকে শুরু করে স্কুলের শিক্ষকেরাও। শুধু যে গান করতেন তাই নয়, ছবি আঁকাতেও ভীষণ পারদর্শী ছিলেন আলতাফ। ১৯৫২ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত বিভিন্ন আন্দোলনে সংগ্রামে তাকে দেখা গেছে প্ল্যাকার্ড, ফেস্টুন, ব্যানার আঁকতে। ছবি। আঁকা ছিল তাঁর নেশা।। কিন্তু তাঁর সবচেয়ে বড় নেশা ছিল গান। নিজে গান লিখতেন, সুর করতেন, গেয়ে শােনাতেন। প্রায় সবরকম বাদ্যযন্ত্র বাজাতে পারতেন তিনি। হারমােনিয়াম, তবলা, বেহালা, পিয়ানাে, বাশি, পারকিনসন সবকিছুতেই পারদর্শী ছিলেন। ষাটের দশকে এসে অর্কেস্টেশন সম্পর্কে বিরল জ্ঞান অর্জন করেন। সে সময়ে। উপমহাদেশের অল্প যে কয়জন সংগীতজ্ঞ এ সম্পর্কে জ্ঞান রাখতেন তাঁদের মধ্যে তিনি ছিলেন অন্যতম। ১৯৩৮ সালে স্থানীয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তির মধ্য দিয়ে শিক্ষাজীবন শুরু হয় আলতাফ মাহমুদের। ১৯৪৩ সালে তিনি বরিশাল জিলা স্কুলে ভর্তি হন। ১৯৪৫’৪৬ সালে বরিশাল ফকিরবাড়ি সড়কে ‘তরুণ মহফিল” নামে সমাজকল্যাণ সংস্থার সাথে জড়িত হয়ে পাঠাগার গড়ায় উদ্যোগী হন কিশাের আলতাফ। ১৯৪৮ সালে বরিশাল জিলা স্কুল থেকে কলকাতা বাের্ডের অধীনে এন্ট্রান্স পরীক্ষায় পাস করেন ও ব্রজমােহন কলেজে ইন্টারমিডিয়েটে ভর্তি হন।
বরিশাল জিলা স্কুলে থাকা অবস্থাতেই মাহমুদ গান গাইতে শুরু করেন। এ সময় তিনি খ্যাতনামা বেহালাবাদক সুরেন রায়ের কাছে সঙ্গীতের তালিম নেন। বিভিন্ন জলসায় কণ্ঠসঙ্গীত পরিবেশন করে প্রশংসা অর্জন করেন আলতাফ। শুধু গান গাওয়া নয়, ছাত্রজীবন থেকেই তিনি একজন সাংস্কৃতিক সংগঠক হিসাবে সক্রিয় হয়ে ওঠেন। পরে চিত্রকলা শেখার জন্য ভর্তি হন কলকাতা আর্ট কলেজে। ১৯৫০ সালে আলতাফ মাহমুদ ঢাকায় আসেন এবং ‘ধূমকেতু শিল্পী সংঘে যােগ দেন। পরবর্তীতে তিনি এই সংস্থার সঙ্গীত পরিচালক পদে আসীন হন। ১৯৫০ সালের দিকে তিনি ভাষা আন্দোলনের পক্ষে সমর্থন আদায়ের জন্য বিভিন্ন জায়গায় গণসঙ্গীত গাইতেন। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির পর আবদুল গাফফার চৌধুরী রচিত ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানাে’ গানটিতে সুর সংযােজন করে সবার। ভালােবাসা কেড়ে নেন আলতাফ মাহমুদ। গানটির প্রথম সুরকার আব্দুল লতিফ হলেও পরবর্তীতে আলতাফ মাহমুদের সুরটিই গৃহীত হয় এবং ১৯৫৪ সাল থেকে তার দেওয়া সুরেই গানটি গাওয়া শুরু হয়। আলতাফ মাহমুদের দেওয়া সুরটি ১৯৬৯। সালে জহির রায়হান তার জীবন থেকে নেয়া’ চলচ্চিত্রে ব্যবহার করেন।
আলতাফ মাহমুদ ১৯৫৩ সালে ভিয়েনা শান্তি সম্মেলনে যােগ দেওয়ার জন্য আমন্ত্রণ পান। কিন্তু করাচিতে পাকিস্তান সরকার তার পাসপাের্ট আটকে দেওয়ায় তিনি আর সেখানে যােগ দিতে পারেননি। ১৯৬৩ সাল পর্যন্ত তিনি করাচিতে অবস্থান করেন। করাচিতে তিনি প্রখ্যাত উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতজ্ঞ ওস্তাদ আবদুল কাদের খা’র কাছে নাড়া বেঁধে সঙ্গীতের আনুষ্ঠানিক তালিম নেন। এছাড়া তিনি বিখ্যাত নৃত্য পরিচালক ঘনশ্যাম এবং চলচ্চিত্র পরিচালক দেবু ভট্টাচার্যের সাথেও সহকারী হিসাবে কাজ করেন। ১৯৫৬ সালে আলতাফ মাহমুদ করাচি বেতারে প্রথম সঙ্গীত পরিবেশন করেন। তিনি ইত্তেহাদে সিকি’ নামে দশ মিনিটের একটি অনুষ্ঠান প্রযােজনা ও পরিচালনা করতেন। করাচি থেকে ঢাকা ফেরার পর আলতাফ মাহমুদ অনেক চলচ্চিত্রে সঙ্গীত পরিচালনা করেন। এগুলাে হলাে : তানহা (বেবী ইসলাম), বাহানা (জহির রায়হান), ক্যায়সে কাহাে (জহির রায়হান), কার বউ (চাষী নজরুল ইসলাম), রহিম বাদশা ও রূপবান (সফদর আলী ভূইয়া), সান অব পাকিস্তান (ফজলুল হক), ময়ূরপঙ্খী (সাদেক খান), আনােয়ারা (জহির রায়হান), আলী বাবা (চাষী নজরুল ইসলাম), বড় বউ (রহিম নেওয়াজ), সপ্তডিঙা (দারাশিকো), মিশর কুমারী (চাষী নজরুল ইসলাম), বেদের মেয়ে (নূরুল হক বাচ্চু), টাকা আনা পাই (বাবুল চৌধুরী), দাতা। হরিশ্চন্দ্র (বাবুল চৌধুরী), চৌধুরী বাড়ি (নাজমুল হুদা), শপথ নিলাম (জীবন। চৌধুরী), কখনাে আসেনি (জহির রায়হান), কুচবরণ কন্যা (নূরুল হক বাচ্চু), সুয়ােরানী দুয়ােরানী (রহিম নেওয়াজ), দুই ভাই (নূরুল হক বাচ্চু), নয়নতারা (কাজী জহির), সকিনা (কারিগর), আপন দুলাল (চাষী নজরুল ইসলাম), অপরাজেয়। (সাফাক), বেহুলা (জহির রায়হান), সংসার (সিনে ওয়ার্ক শিল্পী গােষ্ঠী), আগুন নিয়ে খেলা (আমজাদ হােসেন ও নূরুল হক বাচ্চু), অবুঝ মন (কাজী জহির), ক খ গ ঘ ঙ (নারায়ণ চৌধুরী), আদর্শ ছাপাখানা (মােশতফা মেহমুদ), আঁকাবাঁকা (বাবুল। চৌধুরী), প্রতিশােধ, Wealth in point (documentary), জীবন থেকে নেয়া।
(জহির রায়হান), Let there be light (Jahir Raihan)। আলতাফ মাহমুদ যে সকল গীতিনাট্য, ছায়ানাট্য ও নৃত্যনাট্যের সঙ্গীত পরিচালনা করেছেন সেগুলাে হলাে- নূর আহমেদ রচিত ‘আগামী দিন’, তারাশংকরের ‘দুই। পুরুষ’, পূর্ব-পাকিস্তান শিল্পী সংসদ প্রযােজিত ‘কিষাণের কাহিনী’, পূর্ব-পাকিস্তান শিল্পী। সংসদ প্রযােজিত ‘মজদুর, নিজামুল হক পরিচালিত ‘শিল্পী’, আবদুল মালেক খান। পরিচালিত ‘মায়ামৃগ’, সােভিয়েত ইউনিয়নের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে আমরা। ফুলিঙ্গ’, ড. এনামুল হক রচিত ‘হাজার তারের বীণা’, আমানুল হক রচিত ‘জ্বলছে। আগুন ক্ষেত-খামারে ও ড. এনামুল হক রচিত ‘রাজপথ জনপথ। তিনি যে সকল গণসঙ্গীত সুর করেছেন এবং গেয়েছেন সেগুলাে হলাে : মােশারফ উদ্দিন রচিত ‘মৃত্যুকে যারা তুচ্ছ করিল ভাষা বাঁচাবার তরে’, আবদুল। গাফ্ফার চৌধুরী রচিত ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানাে একুশে ফেব্রুয়ারি’, মােরা। কি দুঃখে বাচিয়া রবাে’, ‘মন্ত্রী হওয়া কি মুখের কথা’, চারণ কবি শামসুদ্দিন আহমদ। রচিত ‘রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন করিলিরে বাঙালি/তােরা ঢাকা শহর রক্তে ভাসাইলি’, নিজের রচিত ‘মেঘনার কূলে ছিল আমার ঘর/হঠাৎ একটা তুফান আইসা ভাইসা। নিল তারে রে’, করাচি বেতারে পরিবেশিত জীবনের মধু মাস মাের দুয়ারে আজ কি। কথা বলে যায়’, শহীদুল্লা কায়সার রচিত ‘আমি মানুষের ভাই স্পার্টাকাস’, স্বরােচিত এ ঝঞা মােরা রুখবাে’, বদরুল হাসান রচিত ‘ঘুমের দেশের ঘুম ভাঙাতে, সংগৃহীত রচনা ‘এই পথ কালাে পথ’, স্বরােচিত ‘হে মহার্ঘ্য, ভাষা সৈনিক গাজীউল হক রচিত ভুলবাে না ভুলবাে না, ভুলবাে না সেই একুশে ফেব্রুয়ারি’, কাজী নজরুল। ইসলামের ‘বিদ্রোহী’ কবিতা, ‘ম্যায় ভূখা হু’, ‘জাগাে কমরেড, ঈষাণ কোণে মেঘ। জমেছে’, ‘হুনছােনি ভাই দেখছােনি, দেখছােনি ভাই হুনছােনি’, ‘স্বর্গে যাবাে গাে, স্বর্গে যাবাে গাে’ এবং সুখেন্দু চক্রবর্তী রচিত ‘বিচারপতি তােমার বিচার করবে যারা, আজ জেগেছে সেই জনতা’।
অনেক ভালােবেসে গান গাইতেন আলতাফ মাহমুদ। হৃদয় দিয়ে গাইতেন। শেখ লুতফর রহমানের ভাষ্য থেকে জানা যায়, ১৯৬৭ সালের ২১, ২২ আর ২৩ ফেব্রুয়ারি পল্টন ময়দানে আয়ােজন হয় “জ্বলছে আগুন ক্ষেত-খামারে’ নামক গীতিনাট্য। আলতাফ মাহমুদ ছিলেন এই গীতিনাট্যের সঙ্গীত পরিচালক, অভিনেতা। আলতাফ মাহমুদের সহ-শিল্পী হিসাবে এখানে অভিনয় করেছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান, অলি আহমদ। সেই দরদি কষ্ঠে পল্টনে লাখাে জনতার সামনে আলতাফ মাহমুদ গেয়েছিলেন- ও বাঙালি, তােরা ঢাকার শহর রক্তে ভাসাইলি। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে আলতাফ থাকতেন রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সের ঠিক বিপরীত দিকে ৩৭০ নম্বর আউটার সার্কুলার রােডের বাসায়। হানাদার বাহিনী রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সে গণহত্যা চালায় এবং টিনশেডগুলােতে আগুন লাগিয়ে দেয়। এ অবস্থায় আলতাফ মাহমুদ ২৬ তারিখ সকালে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে। পাশের বাড়িতে আশ্রয় নেন। ২৭ মার্চ কয়েক ঘণ্টার জন্য কারফিউ শিথিল হলে আলতাফ মাহমুদ সবাইকে নিয়ে কমলাপুরের বৌদ্ধবিহারে আশ্রয় নেন। সেখানে ১৮ দিন থাকার পর আবার চলে আসেন আউটার সার্কুলার রােডের বাসায়। একেবারে প্রথম থেকেই মুক্তিযুদ্ধের সাথে সক্রিয়ভাবে জড়িত হয়ে পড়েন। তিনি। ১৯৭১ সালের মার্চে স্বাধীনতার দাবিতে শহরের যেখানেই বিদ্রোহী অনুষ্ঠান। হতাে, সেখানেই থাকতেন আলতাফ মাহমুদ। এপ্রিলের শেষের দিক থেকে আলতাফ মাহমুদ মুক্তিযােদ্ধাদের জন্য গান রচনায় ব্যস্ত হয়ে পড়েন। গান রচনা, সুরারােপ করা, কণ্ঠ দেওয়া, রেকর্ড করে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে পাঠানাে অত্যন্ত গােপনীয়তার সাথে তিনি এসব করতে থাকেন। জুলাই মাসে আলতাফ মাহমুদের মা ঢাকায় আসেন। ছেলেকে ভারতে চলে যাওয়ার জন্য তিনি বেশ পীড়াপীড়ি করতে থাকেন। স্বাধীন বাংলা বেতারের জন্য গান রেকর্ডিং হয়ে যাওয়ার পর একবার স্থির করেছিলেন, মা ও স্ত্রীকে বরিশালে রেখে তিনি পশ্চিমবঙ্গে চলে যাবেন। কোনাে এক কারণে তিনি পরে এ সিদ্ধান্ত পাল্টান। কেউ প্রশ্ন করলে বলেন, “সবাই ওপারে গেলে এখানে কে থাকবে?” এরপর ঢাকা শহরে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে কতকগুলাে অপারেশনে গুরুত্বপূর্ণ।
ভূমিকাও পালন করেন আলতাফ মাহমুদ। ঢাকা শহরে গেরিলা আক্রমণ চলে ২ নং সেক্টর কমান্ডার খালেদ মােশাররফ ও মেজর হায়দারের নেতৃত্বে। তাদের সহযােগিতা করার জন্য ছাত্র-তরুণদের নিয়ে গঠিত হয় ক্র্যাক প্লাটুন’। এই বাহিনী শহরে বেশ কয়েকটি দুঃসাহসিক আক্রমণ চালিয়ে পাকসেনাদের নাজেহাল করাসহ চেকপােস্টে হানা দেন এবং পাকিস্তানকে সমর্থনদানকারী মার্কিন তথ্যকেন্দ্রে বােমা হামলা চালান। শহরের বিভিন্ন স্থাপনায় অর্থাৎ ডিআইটি ভবন, আজিমপুর বালিকা
বিদ্যালয়, টেলিভিশন ভবন, ওয়াপদা ভবন, পেট্রোল পাম্প, সেনা চেকপােস্টে ক্র্যাক প্লাটুনের সাহসী তরুণরা হামলা চালান। সেক্টর কমান্ডার খালেদ মােশাররফের নির্দেশে হােটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে একটি অপারেশন হয়। এতে যুক্ত ছিলেন আলতাফ মাহমুদ, হাফিজ এবং সামাদ। তারা সিদ্ধান্ত নেন, বিশ্বব্যাংক প্রতিনিধিদের ঢাকায় অবস্থানকালে হােটেলে বােমা বিস্ফোরণ ঘটাবেন। ক্র্যাক প্লাটুনের অন্যতম সদস্য সামাদ নিয়ন সাইনের ব্যবসা করতেন। ঘটনাক্রমে ওই সময় হােটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে নিয়ন সাইনের একটি কন্ট্রাক্ট চলে আসে। নিয়ন বাল্বের ভেতরে বিস্ফোরক ভরে হােটেলের ভেতর পাচার করে দেওয়া হয়। তবে প্রতিনিধি দল হােটেলে আসেনি, তারপরও বিদেশি সাংবাদিকদের জানানাের জন্য হােটেলে বিস্ফোরণ ঘটানাে হয়। এতে ফলও হয়। হােটেলে তখন বহু বিদেশি সাংবাদিক ছিলেন। তাদের মাধ্যমে এই বিস্ফোরণের খবর সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। এদিকে পরিকল্পনা মােতাবেক কাজ না হওয়ায় প্রচুর বিস্ফোরক থেকে যায়। সেগুলাে নিরাপদে রাখার স্থান পাওয়া নিয়ে হয় সমস্যা।
কিন্তু সাহসী আলতাফ মাহমুদ সব গােলাবারুদ তাঁর বাসার কাঁঠাল গাছের নিচে একটা পানির হাউজে রেখে ইট, পাথর, কাঠের টুকরাে দিয়ে ঢেকে রাখেন। এই সময় আলতাফ মাহমুদের আউটার সার্কুলার রােডের বাড়িটি মুক্তিযােদ্ধাদের ছােটখাটো একটি ক্যাম্প হয়ে উঠেছিল। বেশ কয়েকজন মুক্তিযােদ্ধা আশ্রয় নিয়েছিল তাদের বাসায়। কিন্তু এই ক্যাম্প এবং লুকিয়ে রাখা অস্ত্র ও বারুদের খবর কোনােভাবে ফাস হয়ে যায়। ১৯৭১ সালের ৩০ আগস্ট ভােরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী আলতাফ মাহমুদের বাসা ঘিরে ফেলে। এই ঘটনার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে সারা আরা মাহমুদ জানিয়েছেন : ৩০ আগস্ট ভােরবেলা … বুটের আওয়াজ পেয়ে আমি জানালা দিয়ে তাকিয়ে। দেখি আমিরা আমাদের পুরাে বাড়িটা ঘেরাও করে ফেলেছে। আমার ভাই এবং আগের রাতে শেল্টার নেওয়া আবুল বারাক আলভী ছাড়াও আশপাশের বাড়ি থেকে মােট ১১ জনকে ধরে বেঁধে রাখে । আমি যখন আলতাফকে বললাম, আর্মি এসেছে, ও আমাকে বলল, “তুমি এত ভয় পাও কেন?” এটাই ছিল আমার সঙ্গে ওর শেষ কথা। তার পর পরই আর্মিরা ঘরে ঢুকে জিজ্ঞেস করে, “আলতাফ মাহমুদ কৌন হ্যায়?” আলতাফ জবাব দিল, “আমি।” তখনই ওরা আলতাফকে নিয়ে বেরিয়ে গেল। সেই সময় আমি দেখলাম সামাদকে। এই লােকটিই। পরবর্তীতে দেখিয়ে দেয় দুই ট্রাঙ্ক অস্ত্র কোথায় লুকিয়ে আছে। আমিরা। আলতাফকে দিয়ে ওই দুই ট্রাঙ্ক আর্মস্ মাটি খুঁড়ে বের করে নিল এবং আলতাফকে নিয়ে চলে গেল।
অস্ত্রভর্তি ট্রাংক পেয়ে আলতাফ মাহমুদকে কিল, ঘুষি, লাথি মারতে মারতে অস্ত্রের মুখে টেনে-হিচড়ে গাড়িতে তােলা হয়।
১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত বিভিন্ন হাসপাতাল, জেলখানা, ক্যান্টনমেন্ট সবখানেই স্বজনেরা আলতাফ মাহমুদের সন্ধান চালান। কিন্তু কোথাও তার খোঁজ পাওয়া যায়নি। স্বাধীনতার পর জানা গেছে, আলতাফ মাহমুদকে গ্রেফতার করে প্রথমে রমনা থানায় নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। রমনা থানায় মৃত্যুর মুঠোয় বসে সেই অসম্ভব অত্যাচারের মধ্যেও আলতাফ মাহমুদ তাঁর এক শ্যালক খনুকে আক্ষেপ করে বলেছিলেন, “দেশের কোনাে কাজই তাে করতে পারলাম না।” পরে এখানকারই একজন বন্দি তাঁর ওপর নির্যাতনের নানা ভয়ঙ্কর খবর জানিয়ে বলেছিল, ৩ সেপ্টেম্বর চোখ বেঁধে আলতাফ মাহমুদকে কোথাও নিয়ে যাওয়া হয়। তারপর তার সাথে কী করা হয়েছে, কীভাবে তার মৃত্যু হয়েছে তা আজ পর্যন্ত কেউ জানে না। ধারণা করা হয়, পাকবাহিনীর অমানুষিক অত্যাচারে সেপ্টেম্বর মাসের প্রথমদিকেই তার মৃত্যু হয়। আলতাফ মাহমুদের স্ত্রী সারা আরা মাহমুদ এবং তাদের একমাত্র কন্যা শাওন মাহমুদ।
সূত্র : শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষ- আলী মো. আবু নাঈম , ফাহিমা কানিজ লাভা