আমিনুল হক
আমিনুল হকের জন্ম ১৯২৬ সালে কিশােরগঞ্জ জেলার পাকুন্দিয়া উপজেলার পােড়াবাড়িয়া গ্রামে। তার বাবার নাম আবদুল কাদির ভূইয়া এবং মায়ের নাম খােদেজা খাতুন। আমিনুল ১৯৪৫ সালে হােসেনদী হাই স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন। তিনি ময়মনসিংহের আনন্দ মােহন কলেজ থেকে ১৯৪৭ সালে আই. এ, এবং ১৯৪৯ সালে বি. এ. পাস করেন। এরপর কিছুদিন তিনি সরকারি চাকরি করেন। কিন্তু রাজনীতি করার জন্য তিনি সরকারি চাকরি ছেড়ে দেন। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন পাস করে। ১৯৫৬ সালে ময়মনসিংহ জজকোর্ট বারে যােগ দেন আমিনুল হক। আইন পেশার সাথে যুক্ত থাকলেও রাজনীতির প্রতিই আমিনুলের মনােযােগ ও আগ্রহ ছিল বেশি। ব্রিটিশবিরােধী আন্দোলনের একজন কর্মী হিসাবে তার রাজনৈতিক জীবনের শুরু। ব্রিটিশ আমলে মুসলিম লীগের রাজনীতির সাথে যুক্ত। থাকলেও পাকিস্তান আমলে প্রথমে তিনি আওয়ামী মুসলিম লীগ ও পরে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির সাথে যুক্ত হন। তিনি ময়মনসিংহ জেলা ন্যাপের কার্যকরী পরিষদের সদস্য ছিলেন। পরে মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে ন্যাপ পুনর্গঠিত হলে তিনি ভাসানী ন্যাপে যােগ দেন এবং কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য মনােনীত হন। ১৯৫৭ সালে টাঙ্গাইল জেলার সন্তোষ সম্মেলন, জামালপুর জেলার সম্মেলন, ধুপরী সম্মেলন এবং সবশেষে পাবনা জেলার সাহাপুর সম্মেলনে আমিনুল অংশ নিয়েছেন। মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে বিন্নাকৈর সম্মেলনে কৃষক সমিতি গঠিত হলে ভাসানী সভাপতি এবং আমিনুল হক সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তিনি এ দায়িত্বে ছিলেন। সাংসারিক সচ্ছলতা ছিল না আমিনুল হকের। স্ত্রী তাকে ভবিষ্যতে মাথা গোঁজার ঠাইয়ের কথা বললে তিনি বলতেন, “চারদিকে দেখাে, অজস্র মানুষের মাথার ওপর আকাশ ছাড়া কিছুই নেই। বাড়ির পাশের বস্তির দিকে আঙুল দেখিয়ে স্ত্রীকে বলতেন, “এদের দিকে দৃষ্টি দাও, তাহলেই তােমার টাকা টাকা চিন্তা দূর হবে।”
উনসত্তরের গণআন্দোলন ও একাত্তরে অসহযােগ আন্দোলনে আমিনুল হক সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। ১৯৭০ সালের নির্বাচনের সময় তার এক বন্ধু আওয়ামী লীগের হয়ে এমপি হওয়ার জন্য তাকে অনুরােধ করে বলেছিলেন, “আপনার মতাে লােকের প্রয়ােজন আছে। আপনার এক পয়সাও খরচ করতে হবে না, আপনি রাজি হয়ে যান।” উত্তরে তিনি বলেছিলেন, “নির্বাচনে অংশ নেওয়ার জন্য, এমপি মন্ত্রী হওয়ার জন্য আমি নীতি বিসর্জন দিতে পারি না। যে পথে এতদিন চলেছি, ক্ষমতার জন্য সে পথ থেকে বিচ্যুত হতে পারব না।” মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে আমিনুল হক সপরিবার গ্রামে আশ্রয় নিয়েছিলেন। ১৯৭১ সালের ২৬ এপ্রিল তিনি ছােট ভাইকে সাথে নিয়ে ময়মনসিংহ যাওয়ার জন্য বাড়ি থেকে বের হন। প্রথমে যান গফরগাঁও উপজেলার শাখাচুড়া গ্রামে। সেখানে মামার বাড়িতে তিনি থেকে যান, তার ছােট ভাই ময়মনসিংহ চলে যায়। কয়েকদিন পর তিনি ভাইয়ের খোঁজ নেওয়ার জন্য অস্থির হয়ে ময়মনসিংহ শহরে আসেন। ভাইয়ের সাথে দেখা করে গ্রামের বাড়ি ফেরার জন্য ১১ মে বিকেলে ময়মনসিংহ রেলস্টেশনে যান। কিন্তু ট্রেন ছাড়তে দেরি হয়। ট্রেন ছাড়ার কিছুক্ষণ আগে দুজন পাকিস্তানি সেনা তার বগিতে উঠে তাকে ধরে নিয়ে যায়। এরপর তার কোনাে খোঁজ পাওয়া যায়নি। এ ঘটনা সম্পর্কে জানা যায় আমিনুল হকের স্ত্রী রওশন আরা বেগমের ‘আমার স্বামী’ রচনা থেকে। রওশন আরা লিখেছেন :ময়মনসিংহে এসে ভাইকে দেখে বাড়ি ফেরার জন্য অস্থির হয়ে পড়েন। সকলেই হেঁটে বা রিকশায় যেতে বললেন। কিন্তু তার হাতে বােধহয় রিকশা ভাড়া করার মতাে টাকা ছিল না। আর, উনি হাটার কষ্টের কথা মনে করে বােধহয় ৩টা ৩০-এর ট্রেনে গফরগাঁও হয়ে বাড়ি যেতে প্রস্তুত হলেন। কিন্তু ভাগ্য খারাপ। পঞ্চম ট্রেন ছাড়তে ছাড়তে ১০টা বেজে গেল। সঙ্গে ছিলেন আমার এক মামা, উনি ঢাকা যাচ্ছিলেন। হঠাৎ দুজন পাক আর্মি তাকে টার্গেট করে ট্রেনে উঠে সােজা উনাকে জিজ্ঞাসা করল, “তুমি আওয়ামী লীগ কর?” উনি মিথ্যা বললেন, “আমি রাজনীতিই করি না।”
“তুমি কি কর?” ওদের প্রশ্ন। “আমি উকিল”তার জবাব। “উকিলরা বদমাশ, তুমি আমাদের সঙ্গে চল।” পাকবাহিনী তাকে ধরল। আমার মামা বললেন, “উনি শরীফ আদমী, উনার কোনাে দোষ নাই।” এ কথা শুনে পাক আর্মিরা ধমকে উঠে আমার স্বামীর মাথায় রাইফেলের বাঁট দিয়ে আঘাত করে তাকে টেনেহিচড়ে জিপে তুলে নিয়ে যায়। আমরা এ ঘটনা মামার । কাছ থেকে স্বাধীনতার পরে জানতে পারি। (স্মৃতি : ১৯৭১, দ্বিতীয় খণ্ড)। শহীদ আমিনুল হকের স্ত্রীর নাম রওশন আরা বেগম। তাঁদের সংসারে দুই ছেলে ‘ও চার মেয়ে ছিল। ময়মনসিংহ জেলা আইনজীবী সমিতি ভবনের ৩ নম্বর ভবন শহীদ আমিনুল হকের নামে নামাঙ্কিত। এছাড়া সমিতির স্মৃতিফলকেও তাঁর নাম লেখা রয়েছে।
সূত্র : শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষ- আলী মো. আবু নাঈম , ফাহিমা কানিজ লাভা