আবুল খায়ের
শিক্ষাবিদ গবেষক ড. মাে. আবুল খায়ের ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের শিক্ষক। তার জন্ম ১৯২৯ সালের ১ এপ্রিল, পিরােজপুর জেলার কাউখালী উপজেলার গােসান্তারা ব্রাহ্মণডাঙ্গা গ্রামে (কোনাে কোনাে সূত্রে গ্রামের নাম ‘কাঠালিয়া বলা হয়েছে)। তার বাবা মৌলভী মুহম্মদ আব্দুর রশীদ ছিলেন এলাকার সম্মানিত ব্যক্তি। বিপদে-আপদে তিনি সবার পাশে গিয়ে দাড়াতেন। তাঁর মায়ের নাম সৈয়দা ফখরুননেছা। আবুল খায়ের পিরােজপুর সরকারি স্কুল থেকে ১৯৪৫ সালে প্রথম বিভাগে প্রবেশিকা পাস করেন। এরপর কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ১৯৪৭ সালে প্রথম বিভাগে আই. এ. পাস করে তিনি ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। এখান থেকে ১৯৫০ সালে ইতিহাসে দ্বিতীয় শ্রেণিতে তৃতীয় স্থান নিয়ে অনার্স এবং ১৯৫১ সালে। এম. এ. পাস করেন আবুল খায়ের। আবুল খায়েরের শিক্ষকতা জীবন শুরু হয় বরিশালের চাখার ফজলুল হক। কলেজে। তিনি ১৯৫৩-‘৫৫ সাল পর্যন্ত এই কলেজে শিক্ষকতা করেন। ১৯৫৫ সালের শেষের দিকে তিনি কিছুদিন জগন্নাথ কলেজের ইতিহাস বিভাগে শিক্ষকতা করেন। ১৯৫৫ সালের ১২ নভেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস বিভাগের প্রভাষক নিযুক্ত হন আবুল খায়ের।
১৯৫৭ সালে তিনি এই বিভাগের রিডার (বর্তমানে সহযােগী অধ্যাপক) পদে উন্নীত হন। | ছাত্রজীবন থেকেই আবুল খায়ের আমেরিকা বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসের প্রতি দুর্বল ছিলেন। এ বিষয়ে তিনি বেশ কয়েকটা কলামও লিখেছেন। এ কলামগুলাের কারণে তিনি সেখানকার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে বেশ পরিচিতি পান। ১৯৫৯ সালে ইতিহাস বিভাগে প্রথমবারের মতাে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এই কর্মসূচির অধীনে ১৯৫৮ সালে এশিয়া ফাউন্ডেশনের বৃত্তি নিয়ে অধ্যাপক আবুল খায়ের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যান। সেখানকার ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি ১৯৫৯ সালে এম. এ. ও ১৯৬২ সালে পিএইচ. ডি. ডিগ্রি লাভ করেন। তাঁর পিএইচ. ডি. অভিসন্দর্ভ ছিল ১৯৪০-৫৫ সালে ভারত ও পাকিস্তানের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির স্বরূপ’ (United States Foreign Policy in the Indo-Pakistan Sub-Continent, 1940-1955) ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি যে এম. এ. ডিগ্রি করেন সেখানে তার বিষয় ছিল মূলত মার্কিন ইতিহাস তত্ত্ব। এ সময় আবুল খায়ের যেসব প্রবন্ধ লেখেন তাও ছিল মার্কিন ইতিহাস তত্ত্বের সাথে সরাসরি সম্পর্কিত। অধ্যাপক আবুল খায়ের নিজেই উল্লেখ করেছেন যে, তিনি ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় ‘Geographical Factor in History’ এবং ‘Historiography’ নামে দুটি গবেষণা প্রবন্ধ রচনা করেন। ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে আবুল খায়ের মার্কিন ইতিহাস সম্পর্কে যে জ্ঞান অর্জন করেন তাতে তিনিই তকালীন বাংলাদেশে প্রথম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসের বিশেষজ্ঞ হিসাবে স্বীকৃতি পান। ১৯৬২ সালে দেশে ফিরে আবুল খায়ের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস পড়ানাে শুরু করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে মার্কিন ইতিহাস জনপ্রিয়করণে শহীদ অধ্যাপক আবুল খায়েরের উল্লেখযােগ্য ভূমিকা ছিল।
আবুল খায়ের নিজের শরীরের প্রতি বেশ খেয়াল রাখতেন। প্রতিদিন সকালসন্ধ্যায় গােটা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা হাঁটতেন। তাঁর হাঁটার সঙ্গীদের মধ্যে অধ্যাপক * সন্তোষচন্দ্র ভট্টাচার্য, অধ্যাপক আব্দুল্লাহ ফারুক, অধ্যাপক জ্যোতির্ময় গুহ ঠাকুরতা, অধ্যাপক কে. টি. হােসেনের নাম উল্লেখযােগ্য। হাটা শেষে এরা সবাই বসতেন রেসকোর্স ময়দানে। তাদের সেই আড্ডায় রাজনৈতিক বিষয়ে আলাপ-আলােচনা হতাে। আবুল খায়ের একাত্তরে থাকতেন বিশ্ববিদ্যালয় আবাসিক এলাকায় ফুলার রােডের ৩৫/বি নম্বর বাসায়। ২৫ মার্চের কালরাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বর্বরােচিত হামলা নিজ চোখেই প্রত্যক্ষ করেন। অনেকেই তখন বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যায়, কিন্তু তিনি কোথাও যাননি। তিনি প্রায়ই বলতেন, “কী হবে একলা বেচে? দেশের লােকের ওপর এত অন্যায়-অত্যাচার। হচ্ছে, তা কি আমার জীবনের চাইতে বড়?” আবুল খায়ের সবসময় পাকিস্তানি শাসক ও শােষক চক্রের বিরােধিতা করে। গেছেন। স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে মুক্তিযােদ্ধাদেরকে, এমনকি ভারত সরকারকে বহু মূল্যবান তথ্য সরবরাহ করেছেন। দেশের ভেতরে কোথায় কী করা হবে সে বিষয়ে। তিনি মুক্তিযােদ্ধাদের দিকনির্দেশনা দিতেন। বিশেষ জরুরি মানচিত্র এঁকে তিনি মুক্তিযােদ্ধা শিবিরে সরবরাহ করেছেন। সহকর্মী ও ঘনিষ্ঠ অন্যদের সাথে। আলাপকালে আবুল খায়ের প্রায়ই বলতেন, “বর্বর পাকিস্তানিদের সঙ্গে আমাদের একত্রে আর থাকা সম্ভব নয়। আমাদের স্বাধীনতা অবশ্যই চাই।” আবুল খায়েরের এসব তৎপরতার খানিকটা আঁচ পাকিস্তানি সেনাবাহিনী পেয়ে যায়। এ কারণে ১৯৭১ সালের ১৩ আগস্ট রাতে পাকিস্তানি সরকারের উচ্চ মহলের আদেশে পাকিস্তান সামরিক বাহিনী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসা থেকে তাকে গ্রেফতার করে। নিয়ে যায়।
এ সময় আরও কয়েকজন শিক্ষককে আটক করা হয়। বন্দি শিবিরে পাকিস্তানি সেনারা মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিবাহিনী সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহের জন্য তাদের উপর অমানবিক নির্যাতন চালায়। তথ্য সংগ্রহের জন্য পাকসেনারা প্রতি মুহূর্তে মৃত্যুর। হুমকি দিত। এ নিয়ে অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম লিখেছেন : এ সময় অধ্যাপক আবুল খায়েরই ছিলেন তাঁদের নেতা এবং এই নেতৃত্ব তার। বয়ােজ্যেষ্ঠতার নয় বরং তার সাহস, প্রেরণা ও অদমনীয় মনােবলের শ্রেষ্ঠ। পুরস্কার। আবুল খায়েরকে এ সময় হতাশা ঘিরে ধরতে পারেনি, মৃত্যুভয় ভীত করে তুলতে পারেনি। … ডক্টর খায়ের বন্দি শিবিরে বলতেন- বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হয়ে প্রাণের ভয়ে, দৈহিক ও মানসিক নির্যাতনের ভয়ে আমরা ঢাকা। বিশ্ববিদ্যালয়ের মহান সংগ্রামী ঐতিহ্যকে কলঙ্কিত করবাে না। ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বর মাসের শেষের দিকে অন্য শিক্ষকদের সাথে আবুল খায়েরও বন্দিদশা থেকে মুক্তি পান। মুক্ত হয়েই তিনি আবার বিশ্ববিদ্যালয়ে আসতে লাগলেন এবং নির্ভয়ে নিজস্ব মতামত ব্যক্ত করতে লাগলেন সহকর্মীদের মাঝে। তাছাড়া পুরাে উদ্যমে তিনি মুক্তিযােদ্ধাদের সহযােগিতা করতে লাগলেন। ১৪ ডিসেম্বর তিনি শেষবারের মতাে আবার গ্রেফতার হন। ১৪ ডিসেম্বর পাকিস্তান। সেনাবাহিনীর এদেশীয় দোসর আলবদর বাহিনীর একটি দল তাকে ফুলার রােডের ৩৫/বি বাসার সামনে থেকে সকাল ৭টার দিকে ধরে নিয়ে যায়। গ্রেফতার হওয়ার পর তিনি উপলব্ধি করেছিলেন, এই যাত্রাই তার শেষ যাত্রা। তার সাথে গ্রেফতারকৃত অন্যরা হলেন অধ্যাপক সন্তোষচন্দ্র ভট্টাচার্য ও অধ্যাপক গিয়াসউদ্দিন আহমদ। গ্রেফতার হওয়ার সাথে সাথে তাদেরকে পাকিস্তান স্টেট বাসে করে নিয়ে যাওয়া হয়।
স্বাধীনতার পর মিরপুর বধ্যভূমিতে আরও অনেকের সঙ্গে তার গলিত মরদেহ পাওয়া যায়। এ ঘটনার বিবরণ জানা যায় আবুল খায়েরের ছেলে রাশেদুল ইসলামের। জবানিতে। দৈনিক প্রথম আলােকে দেওয়া সাক্ষাৎকার (৩ জানুয়ারি ২০১৫) এবং মানবতাবিরােধী অপরাধের মামলায় পলাতক চৌধুরী মুঈনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামান। খানের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২’তে দেওয়া জবানবন্দিতে (৩ নভেম্বর ২০১৩) রাশেদুল সেদিনের ঘটনার বিবরণ দিয়েছেন। রাশেদুল জানান, ঘটনার সময় তার বয়স ছিল ছয় বছর। একাত্তরের ১৪ ডিসেম্বর তার বাবা আবুল খায়ের একটি শাল গায়ে ফুলার রােডের আবাসিক শিক্ষকদের বাসার সামনে হাটতে বের হন। এ সময় তিনি (রাশেদুল) বাসার বারান্দায় খেলছিলেন। তিনি দেখেন, আবুল খায়ের হাঁটতে বের হওয়ার পর চারপাঁচজন অস্ত্রধারী আগন্তুক তার বাবার কাছে গিয়ে প্রশ্ন করেন, “আপনি কি ড. আবুল খায়ের?” তিনি তেজোদীপ্ত কণ্ঠে বলেছিলেন, “আমি।” আলবদর বাহিনীর নরপিশাচরা তাকে আর কোনাে কথা বলার সুযােগ দেয়নি। অস্ত্রধারীরা গায়ের শাল দিয়ে আবুল খায়েরের চোখ বাঁধে। এ ঘটনা দেখার পর রাশেদুল সঙ্গে সঙ্গে গিয়ে বিষয়টি মাকে জানান। আবুল খায়েরের স্ত্রী সাঈদা বেগম দ্রুত আগন্তুকদের কাছ থেকে খায়েরকে ছাড়াতে এগিয়ে আসেন। এ সময় আগন্তুকেরা অস্ত্র উচিয়ে সাঈদাকে গুলি করার ভয় দেখায়। পরে অধ্যাপক খায়েরকে কাদামাখা একটি মাইক্রোবাসে তােলা হয়। একই সময় তাদের বাসার চতুর্থতলা থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ফজলে মুহিতকেও ধরে ওই মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। রাশেদুল জানিয়েছেন। তারপর দুই দিন কারফিউ। টেলিফোন লাইন কাটা। কারও সঙ্গে কারও যােগাযােগ নেই। ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হলাে। আব্বা আর ফিরে এলেন না।
অনেক খোঁজাখুঁজির পর আব্বার গলিত লাশ পাওয়া গেল। তাকে শনাক্ত করা হয়। , গায়ের শাল দেখে। সেকি করুণ দৃশ্য।
দেশ স্বাধীনের পর তাঁর বাবাসহ অন্য বুদ্ধিজীবীদের যে মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়, তার চালক মফিজ ও অধ্যাপক গিয়াসউদ্দিনের ভাগ্নি মাসুদা বানুর কাছে রাশেদুল শােনেন, আবুল খায়েরসহ অন্য বুদ্ধিজীবীদের অপহরণ ও হত্যায় মুঈনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামান জড়িত ছিল। চালক মফিজের স্বীকারােক্তি অনুসারে মিরপুরের বধ্যভূমি থেকে আবুল খায়েরসহ আরও কয়েকজন বুদ্ধিজীবীর লাশ উদ্ধার করা হয়। স্বাধীনতার পর পত্রিকায় আশরাফুজ্জামানের ‘জল্লাদের ডায়েরি’ প্রকাশিত হলে রাশেদুল তা দেখেন। ওই ডায়েরিতে বুদ্ধিজীবীদের নামের তালিকায় আবুল খায়েরের নামও ছিল। শহীদ আবুল খায়ের ও সাঈদা বেগমের সংসারে তিন ছেলে ও এক মেয়ে ছিল।
সূত্র : শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষ- আলী মো. আবু নাঈম , ফাহিমা কানিজ লাভা