You dont have javascript enabled! Please enable it! আতাউর রহমান খান খাদিম - সংগ্রামের নোটবুক
আতাউর রহমান খান খাদিম
আতাউর রহমান খান খাদিমের জন্ম ১৯৩৩ সালের ১ ফেব্রুয়ারি, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়ার খড়মপুরে। তার বাবা দৌলত আহমেদ খান খাদিম ছিলেন ঢাকা হাইকোর্টের আইনজীবী। মা আঞ্জুমান নেসা খাতুন। তিনি খাদিম ও খাদেম- দুই নামেই পরিচিত ছিলেন।  খাদিম ১৯৪৮ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জর্জ হাই স্কুল থেকে ম্যাট্রিক এবং ১৯৫০ সালে ঢাকা কলেজ থেকে প্রথম শ্রেণিতে ১১তম স্থান নিয়ে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন। এরপর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের। পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হন সম্মান শ্রেণিতে। ছাত্রাবস্থায় খান খাদিম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের আবাসিক ছাত্র ছিলেন। ১৯৫৩ সালে তিনি প্রথম শ্রেণিতে দ্বিতীয় স্থান নিয়ে বি, এসসি. (সম্মান) পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এরপর ১৯৫৪ সালে দ্বিতীয় শ্রেণিতে প্রথম স্থান নিয়ে এম, এসসি. পাস করেন। শিক্ষাজীবন শেষে প্রথমে খাদিম কিছুদিন (১৯৫৫-৫৬) ফিলিপস ইলেকট্রিক কোম্পানিতে এক্স-রে ইঞ্জিনিয়ার পদে চাকরি করেন। কিন্তু তত্ত্বীয় পদার্থ বিজ্ঞানের উপর আগ্রহ থাকায় খান খাদিম কোয়ান্টাম থিওরির উপর পিএইচ. ডি. করতে ১৯৫৯ সালে যান পশ্চিম জার্মানির গােটেনজেন বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং ১৯৬০ সালের শেষের দিকে পিএইচ. ডি. নিয়ে দেশে ফিরে আসেন। দেশে ফিরে ১৯৬০-‘৬২ সাল পর্যন্ত তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বৃত্তিপ্রাপ্ত গবেষক হিসাবে কাজ করেন। তার গবেষণার বিষয় ছিল ‘অ্যাটোমিক থিওরেটিক্যাল ফিজিক্স’। খাদিম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগে ১৯৬৩ সালের ২০ আগস্ট অস্থায়ী প্রভাষক পদে যােগ দেন। একই বছরের ৬ সেপ্টেম্বর তিনি একই বিভাগে বিভাগীয় ফেলাে হিসাবে যােগ দেন। ১৯৬৫ সালের ৫ ডিসেম্বর খাদিম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক নিযুক্ত হন। প্রথমদিকে বি, এসসি, তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থীদের ব্যবহারিক ক্লাস নিতেন আতাউর রহমান খান খাদিম।
 
খাদিম ইলেকট্রনিকস বিদ্যায় যেমন দক্ষ ছিলেন, তেমনি তাত্ত্বিক পদার্থবিদ্যায়ও ছিলেন সমান পারদর্শী। এরকম জটিল দুটি বিষয়ে পাণ্ডিত্য থাকা নিঃসন্দেহে একটি বিরাট ঘটনা। নিয়মনিষ্ঠ খাদিম ঘড়ি ধরে ক্লাসে আসতেন। ঠিক নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত ক্লাস নিতেন। ছাত্র-শিক্ষক সবার কাছ থেকেই তিনি নিয়মানুবর্তিতা, শৃঙ্খলাবােধ আর দায়িত্ববােধ প্রত্যাশা করতেন।  অবিবাহিত আতাউর রহমান খান খাদিম থাকতেন শহীদুল্লাহ হলের (তখন ঢাকা হল) ওয়েস্ট হাউজের বাবুর্চিখানার উপর দ্বিতীয় তলায় এক কক্ষবিশিষ্ট শিক্ষক বাসভবনে। খান খাদিম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক-ছাত্র হিসাবে শহীদুল্লাহ হলে থাকাকালে পূর্ব পাকিস্তানের তখনকার গভর্নর মােনায়েম খানের কুখ্যাত ছাত্রসংগঠন “এন. এস, এফ.’র বহু কুকীর্তি প্রত্যক্ষ করেছিলেন। তিনি ওই পরিবেশ সম্পর্কে হিরণয় সেনগুপ্তকে বলতেন, “I am surrounded by gangsters and murderers.” ২৫ মার্চের কালরাতেও খাদিম নিজের কক্ষেই ছিলেন। মধ্যরাতের পর পাকিস্তান সেনাবাহিনী শহীদুল্লাহ হলে হামলা চালায়। মুহূর্তেই মারা যায় শহীদুল্লাহ হলের নাম না জানা অনেক শিক্ষার্থী এবং দুজন আবাসিক শিক্ষক আতাউর রহমান খান খাদিম এবং গণিত বিভাগের শিক্ষক শরাফত আলী। পাকিস্তানি সেনারা তাদের দুজনকে হত্যা করে গণকবরে আরও অনেকের সঙ্গে মাটিচাপা দেয়।
সেনাদের হাতে খান খাদিম এবং শরাফত আলী কখন, কীভাবে শহীদ হন সে সম্পর্কে সঠিক তথ্য জানা সম্ভব না হলেও তার শিক্ষক ও পরবর্তীতে সহকর্মী অধ্যাপক হিরণয় সেনগুপ্তর এক রচনায় খান খাদিম এবং সেদিনের ঘটনা সম্পর্কে কিছু তথ্য পাওয়া যায়। হিরণায় লিখেছেন : শহীদ খান থাকতেন প্রথমে শহীদুল্লাহ হলে ছাত্রদের নির্ধারিত কক্ষে। তিনি তখন পদার্থবিদ্যা বিভাগে একজন গবেষক-ছাত্র। পরে তিনি চলে যান ওই হলেরই শিক্ষকদের বাসভবনে, যখন তার জন্য ওখানেই বরাদ্দ করা হয় একটি কক্ষ। সেখানেই তিনি শহীদ হন ২৫ মার্চ। গণিত বিভাগের প্রভাষক এবং শহীদুল্লাহ হলের সহকারী আবাসিক শিক্ষক শরাফত আলীও একই সাথে বর্বরােচিত হামলার শিকার হন পাকবাহিনীর হাতে।… শহীদ খান খাদেমকে যারা দেখেছেন তাঁরা জানেন তিনি ছিলেন স্বল্পভাষী। মুখে স্মিত হাসি সর্বক্ষণ লেগে থাকত। কথা বলতেন অতি সংযতভাবে, আর বক্তব্য ছিল পরিষ্কার।  নিরহংকার মানুষটি- এককথায় ভালাে মানুষ এবং যথার্থ ভদ্রলােক। ( স্মৃতি : ১৯৭১, দ্বিতীয় খণ্ড) খান খাদিমের স্মৃতিকে ধরে রাখার জন্যে ১৯৭৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের মাইনর ল্যাবটির নামকরণ করা হয় “খান খাদিম ল্যাবরেটরি’, যেখানে প্রথম তিনি শিক্ষার্থীদের ব্যবহারিক পাঠ দিয়েছিলেন। এছাড়া শহীদুল্লাহ হলের ওয়েস্ট হাউজের কাছাকাছি ২৫ মার্চ রাতের শহীদ আবাসিক শিক্ষকদের একটি নামফলক থাকলেও ২০০৭ সালে তা সংস্কারের নামে সরিয়ে ফেলা হয়, যা পরে আর স্থাপন করা হয়নি।

সূত্র : শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষ-  আলী মো. আবু নাঈম , ফাহিমা কানিজ লাভা