You dont have javascript enabled! Please enable it! আজহারুল হক - সংগ্রামের নোটবুক
আজহারুল হক
ডা. আজহারুল হকের পরিবারের আদি নিবাস পশ্চিমবঙ্গের কৃষ্ণনগর। ১৯৪০ সালের ২ মার্চ তিনি ঢাকায় জন্ম নেন। তার বাবা জহুরুল হক, মা ফাতেমা খাতুন। দুই বছর বয়সে তার বাবা মারা যান। সে সময় তার বাবা ছিলেন ঢাকা সেন্ট্রাল জেলের জেলার। ১৯৪৩ সালে বাবার মৃত্যুর পর আজহারুল হক তার বড় ভাইয়ের কর্মস্থল নােয়াখালী, চট্টগ্রাম, বরিশাল ও সিলেটে লালিত-পালিত হন এবং ওইসব স্থানেই লেখাপড়া করেন।  সিলেট মেডিকেল স্কুল থেকে ১৯৬৩ সালে তিনি এল, এম. এফ. পরীক্ষায় প্রথম স্থান লাভ করেন। তিনি ১৯৬৮ সালে স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ থেকে অনার্স মার্কসসহ এম. বি. বি. এস. ডিগ্রি অর্জন করেন। এক বছরের ইন্টার্নি শেষে ১৯৬৯ সালের ২৬ জুন ঢাকা মেডিকেল কলেজের সহকারী শল্য চিকিৎসক (সার্জন) পদে নিযুক্ত হন আজহারুল। বাবার মৃত্যুর কারণে সাত ভাই ও চার বােনের বড় সংসারে আজহারকে অত্যন্ত অভাবের মধ্যে লেখাপড়া শিখতে হয়েছে। আজহারুল ছিলেন অত্যন্ত প্রাণােচ্ছল ও চঞ্চল প্রকৃতির মানুষ এবং একই সাথে ছিলেন কঠোর পরিশ্রমী। ছােটবেলা থেকেই তিনি খেলাধুলায় ভীষণ মেতে থাকতেন, বিশেষ করে ফুটবল ছিল তার প্রিয় খেলা। ভালো খেলােয়াড় হিসাবে তিনি বহু কাপ, মেডেল ও শিল্ড পেয়েছেন। খেলাধুলা ছাড়াও তিনি ভালাে গান গাইতে পারতেন এবং অভিনয়ও করতেন। স্কুল-কলেজের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তিনি অংশ নিতেন। সিলেটে থাকতে তিনি বহু নাটকে অভিনয় করেছেন। অত্যন্ত সহজ-সরল সাদাসিধে মানুষ ছিলেন আজহারুল। এত বিনয়ী ছিলেন যে কখনও কারও সাথে ‘আপনি’ ছাড়া ‘তুমি’ করে কথা বলেননি। ইংল্যান্ড গিয়ে বড় ডিগ্রি আনার স্বপ্ন ছিল তাঁর সেজন্য সারাদিনের পরিশ্রমের পরও গভীর রাত পর্যন্ত জেগে পড়াশােনা করতেন। একবার সৌদি আরবে তার চাকরি হওয়ার কথা হয়। কিন্তু লেখাপড়ার জন্য ইংল্যান্ড যাওয়ার ব্যাঘাত ঘটবে বলে যাননি। টাকা-পয়সা উপার্জনের দিকে কোনাে ঝোক ছিল না ডা. আজহারের। “ফ্রি স্যাম্পল হিসাবে পাওয়া সব ওষুধ তিনি গরিব রােগীদের বিলি করে দিতেন, এমনকি বিনা পয়সায় বহু ওষুধও দিয়ে দিতেন। বহু রিকশাওয়ালা, বস্তিবাসী তাঁর ভক্ত ছিল।
যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে আজহার বিকালের দিকে কাজী আলাউদ্দিন রােডের ‘শামীম ব্রাদার্স’ নামের ফার্মেসিতে বসতেন। পরে যুদ্ধের সময় ডা. আজহার হাতিরপুলে বাসার কাছেই ‘সাঈদা ফার্মেসিতে বসা শুরু করেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় ডা. আজহারুল হক অনন্য ভূমিকা পালন করেছেন। তার চেম্বার ‘সাঈদা ফার্মেসি’তে যুদ্ধাহত মুক্তিযােদ্ধারা আসতেন গােপনে। ডা. আজহারুল তাদের চিকিৎসা করতেন, ওষুধপত্র দিয়েও সাহায্য করতেন। আহত মুক্তিযােদ্ধাদের চিকিৎসা এবং তাদের সহায়তা করার বিষয়টি একসময় আলবদর বাহিনীর সদস্যদের কানে যায়। তখন আলবদর বাহিনী হাতিরপুলের চেম্বারের ঠিকানায় চিঠি দিয়ে তাঁকে হুমকি দেয়। ১৯৭১ সালের জুলাই মাসের কোনাে এক সময় তাকে পুলিশ সদর দফতরে ডেকে নিয়ে মুক্তিযােদ্ধাদের সপক্ষে তাঁর কার্যক্রমের জন্য কঠোরভাবে শাসানাে হয়। তখন থেকে তিনি তাঁর চেম্বারে আহত মুক্তিযােদ্ধাদের চিকিৎসা বন্ধ করে হাতিরপুল ও এর পার্শ্ববর্তী বস্তি এলাকায় গােপনে চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন। কখনও বা তিনি গভীর রাতে অবাঙালি (বিহারি) অধ্যুষিত মিরপুর ও মােহাম্মদপুরে গিয়ে গােপনে আহত মুক্তিযােদ্ধাদের চিকিৎসা করতেন। আজহারুল হকের স্ত্রী সৈয়দা সালমা হকের রচনা থেকে জানা যায়, তিনি। নিশ্চিত বিপদ জেনেও অনেক রাত পর্যন্ত গােপনে মুক্তিযােদ্ধাদের চিকিৎসা ও অন্যান্য সেবা দিয়েছেন। আবার দিনের বেলায় যথারীতি হাসপাতালের দায়িত্বও পালন করেছেন। তিনি গােপনে আহত, বুলেটবিদ্ধ ও অসুস্থ মুক্তিযােদ্ধাদের ডেরায়। গিয়ে চিকিৎসা করতেন, বুলেট বের করতেন। মুক্তিযােদ্ধাদের একবার চোখে-ওঠা রােগ হয়, তখন ডাক্তার আজহার ওঁদের জন্য ভীষণ কষ্ট করে ওষুধ জোগাড় করে নিজ হাতে পৌঁছে দিয়েছেন। হাতিরপুল এলাকাটা ছিল মুক্তিযােদ্ধাদের ঘাটি। তাই যত ওষুধ, চিকিৎসা সব আজহার করতেন।
১৯৭১ সালের ১৫ নভেম্বর ভাের থেকেই আলবদর বাহিনী ফ্রি স্কুল স্ট্রিট, হাতিরপুল, সেন্ট্রাল রােড এলাকায় কারফিউ জারি করে। কারফিউয়ের খবরে হাসপাতালে যাওয়ার জন্য অস্থির হয়ে ওঠেন ডা. আজহারুল হক। বাড়িওয়ালা হাকিম সাহেবের বাসা থেকে হাসপাতালে অ্যাম্বুলেন্সের জন্য ফোন করে বাসার সদর দরজায় এসে তিনি অপেক্ষা করতে থাকেন। এ সময় হাকিম হাউসের বাসিন্দা ঢাকা মেডিকেলের ইন্টার্নি ডা. হুমায়ুন কবীরও হাসপাতালে যাওয়ার জন্য তার সঙ্গে যােগ দেন। আলবদর বাহিনী অ্যাম্বুলেন্সটিকে ফ্রি স্কুল স্ট্রিটে ঢুকতে দেয়নি। এরই মধ্যে বদর বাহিনীর কয়েকজন সশস্ত্র কর্মী ফটকের সামনে ইউনিফর্ম পরা দুজন ডাক্তারকে দেখে তাদের দিকে এগিয়ে আসে এবং জেরা করতে থাকে। আজহারুল হককে শনাক্ত করতে পেরে একজন আলবদর সদস্য রাইফেল দিয়ে তার। ডান হাতে সজোরে আঘাত করে। এরপর তারা রাইফেল উচিয়ে ডা. আজহারুল এবং ডা. হুমায়ুনকে হাতিরপুলের দিকে নিয়ে যায়। সেখান থেকে একটি জিপে করে তাদের অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।
আত্মীয়-স্বজনরা তাদের সন্ধানে সারাদিন ‘ঢাকা মেডিকেল ও আশপাশে খোজ করেন। পরদিন ভােরেও চলতে থাকে অনুসন্ধান। ১৬ নভেম্বর দুপুরের দিকে ডা. আজহার ও হুমায়ুনের লাশ পাওয়া যায় নটরডেম কলেজের পাশের কালভাটের পূর্ব দিকের ডােবায়। তাদের চোখ, হাত ও পা বাধা ছিল। মৃতদেহের অবস্থা দেখে বােঝা যায় যে কঠোর নির্যাতনের পর শ্বাসরােধ করে তাদের হত্যা করা হয়েছে। ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গে আত্মীয়-স্বজনরা তাদের দুজনকে শনাক্ত করেন। আজহারুল হকের স্ত্রী সৈয়দা সালমা হক লিখেছেন : আমাদের বাসার গেটের কাছে যে তেঁতুলগাছটি, সেখানে দাঁড়িয়ে আজহার ও হুমায়ুন কবীরের সাথে আলবদররা কথা বলছিল, সামনের তিনতলা বিল্ডিংয়ের ভাড়াটে ভদ্রলােক উপর থেকে সব প্রত্যক্ষ করেছেন। এ দৃশ্য ঝাপফেলা কয়েকজন দোকানিও ঝাপের ফুটা দিয়ে দেখেছেন। কিন্তু দূরত্বের জন্য কী কথাবার্তা হচ্ছিল, তা আর কেউ বুঝতে পারেনি। তবে এক পর্যায়ে আজহার তেঁতুলগাছে হাত ঠেস দিয়ে যখন কথা বলছিলেন, তখন ওরা ডাক্তারের হাতের ডানায় রাইফেল দিয়ে মারে। ডাক্তার তখন থতমত খেয়ে ও হতভম্ব হয়ে সােজা হয়ে দাঁড়ায় এবং মুখটা নাকি ফ্যাকাসে হয়ে যায়। সাথে সাথে কয়েকজন এসে সামনে-পিছনে রাইফেল তাক করে তাদের দুজনকে তেঁতুলগাছের তলা থেকে হাতিরপুল পর্যন্ত হাঁটিয়ে নিয়ে গিয়ে একটি জিপ গাড়িতে তােলে। সেই গাড়িতে নাকি হাতিরপুল এলাকার আজিজ ওয়ার্কশপের মালিক খান নামে পরিচিত বিহারি লােকটি ছিল। সে লােকই নাকি সে সময় দালালি করত।
শুনেছি নরপশুরা ডাক্তারকে কোনাে গুলি খরচ করে নয়, এমনকি বেয়নেট দিয়েও নয়, শুধু পিটিয়ে শ্বাসরােধ করে হত্যা করেছিল। এই কি সহ্য করা যায়? কী যন্ত্রণা, কী কষ্টই না দিয়ে ওর তরতাজা ৩১ বছরের জীবনটা বের করেছে। (স্মৃতি : ১৯৭১, প্রথম খণ্ড) প্রগতিশীল চিন্তার অধিকারী আজহারুল হক সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড ও সাহিত্য চর্চায় অনুরাগী ছিলেন। শহীদ হওয়ার সময় ডা. হকের স্ত্রী সৈয়দা সালমা হক সন্তানসম্ভবা ছিলেন। ১৯৭২ সালের ১৪ জানুয়ারি সৈয়দা সালমা হক এক ছেলের জন্ম দেন। তার নাম রাখা হয় আশরাফুল হক নিশান।

সূত্র : শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষ-  আলী মো. আবু নাঈম , ফাহিমা কানিজ লাভা