অবনী মােহন দত্ত
অবনী মােহন দত্ত ১৯১৬ সালে কুমিল্লায় দেবীদ্বার উপজেলায় জন্ম নেন। বাবা শরৎচন্দ্র দত্ত ও মা স্বর্ণাকুমারী দত্তের একমাত্র সন্তান ছিলেন অবনী মােহন। অবনী মােহন দত্ত ছাত্র হিসাবে অত্যন্ত মেধাবী ছিলেন। তিনি ১৯৩৪ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে দর্শন বিষয়ে এম. এ. পাস করেন। শিক্ষাজীবন শেষে তিনি কয়েক বছর পশ্চিম পাকিস্তানের গুজরানওয়ালা কলেজে উপাধ্যক্ষ হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। এরপর তিনি যােগ দেন রাজশাহী সরকারি কলেজের দর্শন বিভাগে। ১৯৫৮ সালে তিনি চট্টগ্রাম সরকারি কলেজে বদলি হন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শন বিভাগ খােলা হলে তিনি কিছুদিন সেখানে খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসাবে পড়িয়েছেন। ১৯৭১ সালে অবনী ছিলেন চট্টগ্রাম সরকারি কলেজের দর্শন বিভাগের জ্যেষ্ঠ শিক্ষক। শিক্ষক হিসাবে তিনি ছিলেন সুশৃঙ্খল ও সেরা মানের। শিক্ষার্থীরা ছিল তাঁর। কাছে সন্তানের মতাে। তার বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থীদের সবাই ছিল তাঁর গুণগ্রাহী। অন্যদিকে, কলেজের সব শিক্ষকের সঙ্গেও তার ছিল সহজ সম্পর্ক। অবনী মােহন। দর্শন বিষয়ে দুটি বই লিখেছিলেন। ইংরেজিতে অত্যন্ত দক্ষ ছিলেন অবনী, বলতেন ও লিখতেন নির্ভুল এবং অসাধারণ। এজন্য ইংরেজি সাহিত্যের শিক্ষকরাও তাঁর কাছে পাঠদানে সাহায্যের জন্য আসতেন। অবনী মােহন বলতেন, হিন্দুধর্মাবলম্বী হিসাবে মৃত্যুর পর তার দেহ দাহ করারই কথা, কিন্তু তা না করে কোনাে ফলদায়ী বৃক্ষের গােড়ায় সমাহিত হলে সেই বৃক্ষ আরও কিছুদিন বাঁচার উপাদান পাবে, তাতে তার জীবনের সামান্য হলেও কিছু মূল্য থাকবে। অবনী মােহন দত্ত মানবতাবাদী জীবনদর্শনে বিশ্বাস করতেন।
প্রতিদিন তিনি সব ধর্মের, সব শ্রেণির মানুষের জন্য মঙ্গল কামনায় প্রার্থনা করতেন। অজাতশত্রু এই শিক্ষককে পাকিস্তানি সেনারা একাত্তরের ৮ মে তার বাসা থেকে তুলে নিয়ে যায়। দেশ ছেড়ে যাওয়ার অনেক সুযােগ ছিল তাঁর। কিন্তু দেশের এই মহাবিপদের মধ্যে নিজের জীবন বাঁচানাে অবনী মােহন দত্ত জরুরি মনে করেননি। চট্টগ্রাম জেলা মুক্তিযােদ্ধা কমান্ডার মােহাম্মদ সাহাবউদ্দিনের মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রাম বইয়ে অবনী মােহন দত্তকে ধরে নিয়ে যাওয়ার ঘটনাটি জানা যায়। তাঁকে কবে, কোথায়, কীভাবে হত্যা করা হয়েছে, তা আজ পর্যন্ত জানা যায়নি। বাংলাদেশ সরকারের ডাক বিভাগ ১৯৯৯ সালের শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে অষ্টম পর্যায়ে প্রকাশিত শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মারক ডাকটিকিটে শহীদ অবনী মােহন দত্তের ছবি প্রকাশ করেছে। শহীদ অবনী মােহন দত্তের স্ত্রীর নাম ছিল মনিমালা দত্ত। তাদের সংসারে চার ছেলে এক মেয়ে। একমাত্র মেয়ে মঞ্জুহাসি দত্ত সরকারি কমার্স কলেজের অধ্যাপক ছিলেন। তাঁর স্বামী চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ড. সৌরেন বিশ্বাস জানিয়েছেন : অবনী মােহন দত্তের নামে বিশ্ববিদ্যালয়ের কাটা পাহাড়ের মাঝে একটি রাস্তার নামকরণ করা হয়েছিল। কিন্তু কিছুদিন পরই রাতের আঁধারে উপড়ে ফেলা হয়। সে নামফলক। নতুন প্রজন্ম এটিকে কাটা পাহাড়ের রাস্তা নামেই চেনে। এখন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা চট্টগ্রাম কলেজের কোথাও নেই তার কোনাে স্মৃতিস্মারক। এমনকি বুদ্ধিজীবী চত্বরেও নেই তাঁর পরিচিতিমূলক কোনাে বর্ণনা। বাংলাদেশ সরকারের দেওয়া কোনাে সুযােগ-সুবিধাও পাচ্ছে না অবনী মােহনের । পরিবার। (দৈনিক সমকাল, ১৪ ডিসেম্বর ২০১৭)
সূত্র : শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষ- আলী মো. আবু নাঈম , ফাহিমা কানিজ লাভা