ভারতীয় মুসলমান ও বাংলাদেশ
— ফেরদৌস কোরেশী
বাংলাদেশ প্রশ্নে ভারতীয় মুসলমানদের একাংশ এবং বিশ্বের অধিকাংশ মুসলিম রাষ্ট্রের ভূমিকা আজ আর। মােটেই প্রশ্নাতীত নয়। বাংলাদেশের সাতকোটি মুসলমানকে ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে আজ যে বর্বর দস্যুতার মােকাবিলা করতে হচ্ছে প্রতিবেশী রাষ্ট্রের মুসলমানরা সেদিকে চোখ বুজে থাকবেন এবং প্রকারান্তরে পশ্চিম পাকিস্তানী জংগীশাহীকে সমর্থন জানাবেন এর চাইতে দুঃখজনক ঘটনা আর কি হতে পারে। এই উপমহাদেশের রাজনীতিক্ষেত্রে বিভিন্ন পর্যায়ে সাম্প্রদায়িকতার বিচিত্রমুখী বহিঃপ্রকাশ রাজনীতির স্বাভাবিক গতিপ্রবাহকে কতবারই না ভুলপথে প্রবাহিত করেছে। বাংলাদেশের প্রশ্নে ভারতীয় মুসলমানদের এই ভূমিকাদৃষ্টে মনে হচ্ছে আমাদের দুর্দিনের অমানিশার এখনাে বুঝি শেষ হয় নি। প্রায়শ্চিত্তের বুঝি এখনাে অনেক বাকী। | বাংলাদেশ পৃথিবীর অন্যতম মুসলমান অধ্যুষিত অঞ্চল। একই অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও ভাষাগত কাঠামাের মধ্যে এত বেশি সংখ্যক মুসলমান পৃথিবীতে আর কোথাও বসবাস করে না। ইসলামের মর্মবাণী গ্রামবাংলার দরিদ্র চাষির হৃদয়ের গভীরে যেভাবে চিরস্থায়ী আসন লাভ করেছে, তার তুলনা বিরল। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পেছনে বাংলার মুসলমানদের মুখ্য ভূমিকা গ্রহণের কথাও কারাে অবিদিত নয়। কিন্তু তথাকথিত পাকিস্তানে পাঞ্জাবের সীমান্ত ও ধনিকশ্রেণী সামরিক বাহিনীর মাধ্যমে সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালিদের উপর তেইশ বৎসর যাবৎ যে নির্মম ও নিষ্ঠুর শাসন চালিয়ে এসেছে, বিগত দিনের ঔপনিবেশিক শশাষণকেও তা নিঃসন্দেহে ম্লান করে দিয়েছে।
শােষণের হাত থেকে রক্ষা পাবার জন্যই একদিন এই উপমহাদেশের মানুষ ইংরেজের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরেছে। শােষণের হাত থেকে রক্ষা পাবার জন্যই আজ বাংলার মানুষ পশ্চিম পাকিস্তানী কায়েমী স্বার্থের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেমেছে। অত্যাচারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরােধ গড়ে তােলা ইসলামের দৃষ্টিতে ধর্মযুদ্ধ। মহানবী হজরত মােহাম্মদ নিজে কখনাে অত্যাচারীর সাথে আপােষ করেন নি। অন্যায়কে চোখ বুজে সহ্য করার, এক গালে চড় খেয়ে অন্য গাল পেতে দেবার শিক্ষা ইসলামের শিক্ষা নয়। ইসলাম প্রত্যক্ষ কর্মপন্থায় বিশ্বাসী। অন্যায়কে প্রতিহত করার জন্য কোষমুক্ত তরবারী ইমানদার মুসলমানের প্রথম সুহৃদ। বাংলাদেশের মুসলমানরা আজ পশ্চিম পাকিস্তানী পেশাদার সৈন্যবাহিনীর বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরেছে। পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যরাও মুসলমান, বাংলাদেশের মুক্তিযােদ্ধারাও শতকরা ৯৮ জন মুসলমান। একদা এজিদের বিরুদ্ধে হাসান হােসেনকেও জেহাদে যেতে হয়েছে। অত্যাচারী পাপাচারীর হাত থেকে নিরপরাধ সাধারণ মানুষকে রক্ষা করার জন্য যুদ্ধ ঘােষণা করতে হয়েছে। হাসান হােসেন প্রাণ দিয়েছেন, কিন্তু সত্যেরও প্রাণ প্রতিষ্ঠা ঘটেছে সেই মহৎ মৃত্যুতেই। জল্লাদ এজিদ সেদিন জয়ী হয়েছিল, সে আজ নিক্ষিপ্ত ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে। ভারতের মুসলমানদের অনেকের ধারণা পাকিস্তানের অস্তিত্বই ভারতের অভ্যন্তরে তাদের নিরাপত্তার একমাত্র রক্ষা কবচ। দেশ বিভাগের পূর্ববর্তী সময়ে এই উপমহাদেশের দুই প্রধান ধর্মীয় সম্প্রদায় পরস্পরকে যে সন্দেহের চোখে দেখে এসেছে, ভারতীয় মুসলমানদের এই মনােভাব তারই প্রতিফলন। তারা মনে করেন, স্বাধীন বাংলাদেশ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ হলেও তা হবে একান্তভাবেই ধর্মনিরপেক্ষ । তেমন অবস্থায় ভারতের অভ্যন্তরে সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলাের মুসলমানবিরােধী ভূমিকার মােকাবিলায় ভারতের মুসলমানরা বাংলাদেশের কাছ থেকে কোনাে প্রকার সহায়তা পাবেন না। অন্যদিকে বাংলাদেশ আলাদা রাষ্ট্রে পরিণত হবার পর পশ্চিম পাকস্তিান সব দিক দিয়ে এত বেশি দুর্বল হয়ে পড়বে যে, উপমহাদেশের সাম্প্রদায়িক ভারসাম্য বজায় রাখার প্রশ্নে তার কোনও ভূমিকাই থাকবে না।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠাকালীন একদেশদর্শী চেতনার ভিত্তিতেই যে ভারতীয় মুসলমানরা এসব যুক্তি খাড়া করেছেন, তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই। আজ থেকে ৩০ বৎসর আগে সাম্প্রদায়িকতার মােহাচ্ছন্ন দৃষ্টিতে সাম্প্রদায়িক ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে মুসলমানদের জন্য পৃথক আবাসভূমির দাবী তােলা হয় । সেদিনের সাম্প্রদায়িক ভেদ-বিদ্বেষের পটভূমিতে দেশবিভাগ হয়তাে বা অনিবার্য হয়েই উঠেছিল। সে প্রসঙ্গ অন্যত্র আলােচনা করা যাবে। কিন্তু আজকের দিনে পাকিস্তানের ২৩ বৎসরের ‘ধর্মীয় ভ্রাতৃত্বের সুমহান দৃষ্টান্তটি’ সামনে রেখে এ কথা কি বিনা দ্বিধায় বলা যায় না যে, ‘ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার সেই বিলাতী এক্সপেরিটমেন্ট আসলে বানরের পিঠেভাগ ছাড়া আর কিছুই ছিল না। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগ হবার পর কি সত্যই সাম্প্রদায়িক ভারসাম্য’ প্রতিষ্ঠা হয়েছে। পাকিস্তানের অস্তিত্ব কি সত্যই ভারতীয় মুসলমানদের সাম্প্রদায়িক স্বার্থের অনুকূল হয়েছে। | পাকিস্তানে এবং ভারতে দু’দেশেই একশ্রেণীর মানুষ সংখ্যালঘুদের ন্যাশনাল হােস্টেজে’র অধিক কিছু | বিবেচনা করে না। এদের মতে পাকিস্তানের হিন্দু এবং ভারতের মুসলমানরা পরস্পরের জামিন। সম্ভবত ১৯৫১ সালে লিয়াকত নেহেরু চুক্তির সময়ও কারাে কারাে মনে এই একই মানসিকতা বজায় ছিল। ফলে ‘সংখ্যালঘু’ শব্দটি উভয় দেশেই কমবেশী চালু থেকেছে। তথাকথিত ইসলামী রাষ্ট্র পাকিস্তানে তাে বটেই, ধর্মনিরপেক্ষ ভারতেও সংখ্যাগুরু এবং সংখ্যালঘুর শ্রেণীগত পার্থক্য বজায় থেকেছে আইনগত ভাবেই। | ‘লিয়াকত-নেহেরু চুক্তি, বাহ্যত সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা বিধান এবং দুই দেশের সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা প্রশমনের বলিষ্ঠ প্রচেষ্টা হিসাবে অভিনন্দিত হলেও এ চুক্তি আসলে দুই সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের স্বার্থের আপােষ ছাড়া আর কিছুই নয়। বলাবাহুল্য, এই চুক্তিতে প্রকারান্তরে ভারতের মুসলমানদের প্রতি পাকিস্তানের এবং পাকিস্তানের হিন্দুদের প্রতি ভারতের দায়িত্ব স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে। ফলে এই ২৩ বৎসর যাবৎ ভারতের মুসলমান এবং পাকিস্তানের হিন্দুরা নিজ দেশে পরবাসী হয়েই থেকেছেন।
স্বদেশের বৃহত্তর রাজনৈতিক ও সামাজিক কর্মকাণ্ড থেকে তারা একরকম বিচ্ছিন্ন হয়ে কালাতিপাত করেছেন এবং স্বাভাবিকভাবেই স্বদেশের চাইতে প্রতিবেশী স্বজাতির প্রতিবেশী আনুগত্য পােষণ করেছেন-এখনাে করছেন। পাকিস্তানে এবং ভারতে উগ্র সাম্প্রদায়িকতাবাদীরা যেভাবে সংখ্যালঘুদের দেশপ্রেমের উপর কটাক্ষ করে থাকে সে দৃষ্টিতে নয়, বাস্তব অবস্থার বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণের মাধ্যমেই উপমহাদেশের সংখ্যালঘু সমস্যাটিকে উপলব্ধি করতে হবে। সংখ্যাগুরুদের মানসিকতার নিক্তিতে পাকিস্তানে বসবাসকারী হিন্দুদের কিংবা ভারতে বসবাসকারী মুসলমানদের স্বদেশপ্রেমের পরিমাপ করতে যাওয়া রীতিমতাে অন্যায়। যে রাষ্ট্র পূর্ণ নাগরিকের অধিকার দেয় না-সে রাষ্ট্রকে স্বদেশ ভাবতে না পারাটা কিছুতেই অপরাধ হতে পারে না। বিমাতাকে মায়ের মতাে ভালােবাসা যায় না-এটাইতাে স্বাভাবিক। | পাকিস্তানে হিন্দুরা প্রকাশ্যেই দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হিসাবে ঘােষিত ‘তৃতীয় শ্রেণী’ বলাই বােধ হয় অধিকতর যুক্তিসংগত। পশ্চিম পাকিস্তানীরা প্রথমশ্রেণী, বাঙালি মুসলমান দ্বিতীয়শ্রেণী আর বাঙালি হিন্দু তৃতীয়শ্রেণী। রাষ্ট্রপ্রধান পদে মুসলমান ছাড়া আর কারাে নির্বাচিত হবার অধিকার নেই। অবশ্য ইংল্যান্ড, যুক্তরাষ্ট্র গণতন্ত্রের পীঠস্থান হিসাবে বন্দিত আরাে অনেক ইউরােপীয় রাষ্ট্রেও এধরনের সংকীর্ণ সাম্প্রদায়িক বিধান বহাল রয়েছে। তবে সবচাইতে ন্যক্কারজনক ব্যাপার হলাে পাকিস্তানের ক্ষমতাসীন চক্রের চিরন্তন হিন্দু বিদ্বেষ ও ভারত বিদ্বেষ, যা-কি না রাষ্ট্রীয় জীবনের সর্বক্ষেত্রেই হিন্দু সম্প্রদায়কে অপাংক্তেয় করে রেখেছিল, ইংল্যান্ড আমেরিকায় রাষ্ট্রপ্রধান নির্বাচনের প্রশ্নে অগণতান্ত্রিক বিধি বিধান চালু থাকলেও সেখানকার জনজীবনে সাম্প্রদায়িক চেতনা অনুপস্থিত। অন্তত সেখানে রাষ্ট্রীয় প্রশাসনিক ক্ষেত্রে ধর্মীয় সংখ্যাগুরু এবং সংখ্যালঘুর পৃথক অস্তিত্বই অনুপস্থিত। পাকিস্তানের শাসকদের কাছে হিন্দু হওয়াটাই একটা অযােগ্যতা।
এই অযােগ্যতা কাটিয়ে অন্যদের পাশাপাশি দাড়াতে স্বভাবতই ‘ডবল যােগ্যতার প্রয়ােজন হয়। ভারতে মুসলমানদের কেউ কেউ উচ্চপদে অধিষ্ঠিত হয়েছেন। কংগ্রেসের সভাপতি রাষ্ট্রপতি, প্রধান বিচারপতি ইত্যাদি উচ্চতম আসনে আসীন হয়েছেন-শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতিক্ষেত্রে চরম উৎকর্ষ লাভ করেছেন। এসব থেকে একথা মনে হওয়াই স্বাভাবিক যে, ভারতে মুসলমানরা পূর্ণ নাগরিক অধিকার ভােগ করছেন। ভারতীয় হিন্দুদের কেউ কেউ ক্ষোভের সাথে একথাও বলে থাকেন যে, আসলে মুসলমানরা তাদের প্রাপ্যের চাইতে অনেক বেশি ভােগ করছে। কথাটা অন্তত চাকুরী বাকুরীর ক্ষেত্রে সত্য নয়। তবে প্রাপ্যের চাইতে বেশি ভােগ না করলেও মুসলমানদের প্রতি ভারত সরকারের নীতি হিন্দুদের প্রতি পাকিস্তান সরকারের নীতির চাইতে অনেক বেশি মানবিক, তাতে কোনও সন্দেহের অবকাশ নেই। ধর্মনিরপেক্ষতার প্রশ্নে ভারতের মনােভাব সুস্পষ্ট। কংগ্রেস এবং অন্যান্য মধ্যম বা বামপন্থী দলগুলি মুসলমানদের স্বার্থ রক্ষার প্রশ্নে যথেষ্ট সচেতন। দেশবিভাগের পর উচ্চশিক্ষিত ও প্রভাবশালী মুসলমানরা দেশত্যাগ করার পরও আজ ভারতের রাজনীতি ক্ষেত্রে মুসলমানদের প্রভাব-প্রতিপত্তি উপেক্ষনীয় নয়। কিন্তু, তা সত্ত্বেও ভারতের মুসলমানরা সামগ্রিকভাবে হতাশায় ভুগছেন এবং এই হতাশা থেকেই সাম্প্রদায়িক রক্ষণশীলতার জন্ম নিলে।
সংবেদনশীল মন নিয়ে ভারতীয় মুসলমানদের এই মানসিকতার মনস্তাত্বিক বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে বৃহত্তর জনজীবনের সামগ্রিক অনুভূতিকে আত্মস্থ করে নেবার অক্ষমতাই মুসলমানদের হতাশার অন্ধকারে নিক্ষিপ্ত করেছে। কেবলমাত্র মুসলমান সমাজের স্বার্থচিন্তা ও আত্মমগ্নতাই এর জন্য দায়ী নয়, সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুসমাজের একাংশের প্রতিশােধস্পৃহাও এর জন্য সমভাবে দায়ী। নীতিগতভাবে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রব্যবস্থা কায়েম করলেই মন্ত্রবলে সম্প্রদায়িকতা দূর হয়ে যায় না। শত বহুরে লালিত পাপের প্রায়শ্চিত্তেও অনেক সময়ের প্রয়ােজন। তাই বুঝি পাকিস্তানের জামাত-ই-ইসলামী কিংবা মুসলিম লীগের অনুরূপ গােড়া ধর্মান্ধ দলের প্রাধান্য ভারতের বুকেও বাড়ছে বই কমছে না। সেখানকার জনজীবনে ভারতীয় সংস্কৃতি ও হিন্দু পুনরুজ্জীবনবাদ অভিন্ন হয়ে ওঠার ফলে জাতীয় ভাবধারায় হিন্দুয়ানীর আমদানী ঘটেছে-হয়তাে বা বিনা পরিকল্পনাতেই। | ফল কিন্তু কমবেশি একই। পাকিস্তানের জীবনে মুসলমানিত্বের প্রসার ঘটানাের চেষ্টা হয়েছে রাষ্ট্র যন্ত্রের মাধ্যমে পরিকল্পিতভাবে, ভারতে হিন্দুয়ানীর প্রসার ঘটছে সংখ্যাগরিষ্ঠের আত্মভিমানের অনিবার্য ফলশ্রুতি হিসাবে। মনে রাখা দরকার ভারতের প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলসমূহ এবং সংস্কৃতিমনা উদারচেতা বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় ধর্মনিরপেক্ষ চেতনার অধিকারী হলেও শতাব্দীর সঞ্চিত পাপ এবং সেই পাপের বিষবৃক্ষ ‘পাকিস্তান’ যতক্ষণ মাথা উচিয়ে পঁড়িয়ে থাকছে, ততক্ষণ এই উপমহাদেশ থেকে সাম্প্রদায়িকভাবে অবসান ঘটানাের আশা অবাস্তব কল্পনা ছাড়া আর কিছুই নয়।
ভারত পাকিস্তানের চিরস্থায়ী শত্রুতাই হিন্দু-মুসলমানের দৈনন্দিন সংঘাতের চিরন্তন উৎস। বকুত দঙ্গকে নিন্দা করার আগে পাঙ্গার সেই উৎসবে চিহ্নিত করা দরকার। | এখন প্রশ্ন হলাে, ভারতের মুসলমানরা ভারতের বুকে পূর্ণ নাগরিকত্বের অধিকার এবং দায়িত্ব নিয়ে বাঁচতে চান, না কি ভারত-পাকিস্তান সংঘাতের সুযােগ নিয়ে তৃতীয়পক্ষের মতাে কিছু সুযােগ সুবিধা নিয়েই তারা খুশি থাকবেন। একদেশের বাসিন্দা হয়েও অপর একটি দেশের দিকে তাকিয়ে থাকার দুর্ভাগ্য ষ্ঠায়া কি চিরকালই বয়ে বেড়াবেন? (একই প্রশ্ন পাকিস্তানের হিন্দুদের জন্য প্রযােজ্য হলেও এক্ষেত্রে সেটা অবাস্তব।) | পাকিস্তান ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধংদেহী মনােভাব নিয়ে টিকে থাকলে ভারতের মুসলমানদের দরকথাকষির কিছুটা সুবিধা হয়তাে হয়, কিন্তু পরকঘাকষির প্রয়ােনইতাে থাকে না যদি উপমহাদেশে যথার্থ ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবেশ গড়ে ওঠে। আর তা না হয়ে, পকিস্তান যদি তথাকথিত ইসলামী রাষ্ট্র’ হিসাবে বহাল থাকে তাহলে ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু-সমাজ ভারতকে আমলে’ পরিণত করার স্বপ্ন দেখলে তাতে দোষটা কোথায়? ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক নেতৃত্বকে বাস্তবক্ষেত্রে প্রতি পদে পদে এই কঠিন প্রশ্নের সম্মুখীন হতেই হবে, আর সেক্ষেত্রেই ভারতের বুকে ধর্মীয় পুনরুজ্জীবনবাদীদের পােয়াবারাে হবারই সম্ভাবনা। ভারতের মুসলমানরা কি এ দিকটা ভেবে দেখেছেন?
সাম্প্রদায়িক ভারসাম্যের থিওরির উদগ্যাতারা সম্ভবত আর একটি বর্তমানে বিষয় ভেবে দেখছেন না। ভারতে মুসলমানদের সংখ্যা সাত-আট কোটির কম নয়। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানে হিন্দুর সংখ্যা প্রায় শূন্য। বাংলাদেশে ইয়াহিয়ার বর্বর হামলার পূর্ব পর্যন্ত হিন্দু ছিলেন এক কোটির কিছু বেশি এখন ভারতের মাটিতে। শরণার্থী। তাহলে ভারসাম্যই বা কোথায়? | পাকিস্তানের বর্তমান শাসকগােষ্ঠির সুস্পষ্ট নীতি হলাে, বাংলাদেশকে হিন্দুশূন্য করে সেখানে ধর্মীয় উন্মাদনা সৃষ্টি করা, যাতে করে সাম্প্রদায়িক দলগুলির জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি হয়। বাংলাদেশের প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলগুলিকে বে-আইনী করে দিয়ে, গণতন্ত্রমনা কর্মীদের দেশত্যাগ বাধ্য করে, পাকিস্তানে সামরিক শাসকচক্র যে চণ্ডনীতি চালিয়ে যাচ্ছেন তাতে করে আগামী কিছুকালের মধ্যে বাংলাদেশের সব হিন্দুকেই হয়তাে ভারতে চলে যেতে হবে। দখলীকৃত বাংলাদেশে হিন্দুদের পক্ষে বসবাস করা কিছুতেই সম্ভব নয়। তাহলে ফল দাঁড়াচ্ছে এই যে, বাংলাদেশ তার স্বাধীন সত্ত্বা নিয়ে পরিপূর্ণরূপে আত্মপ্রকাশ করতে না পারলে আগামীতে তথাকথিত পাকিস্তানে কোনাে হিন্দুদের পক্ষে বসবাস করা কিছুতেই সম্ভব নয়। | তাহলে ফল দাঁড়াচ্ছে এই যে, বাংলাদেশ তার স্বাধীন সত্ত্বা নিয়ে পরিপূর্ণরূপে আত্মপ্রকাশ করতে না পারলে আগামীতে তথাকথিত পাকিস্তানে কোনও হিন্দুর অস্তিত্ব থাকবে না। ভারতের মুসলমানরা তখন তাদের ভারসাম্য’ খুঁজে পাবেন কোথায়? হিন্দুশূন্য পাকিস্তান কি তখন ভারতের মুসলমানদের জন্য চিরন্তন অভিশাপ হয়েই বিরাজ করবে না? পরিষ্কার ভাষায় নয় সত্যটাকে প্রকাশ করতে গেলে বসতে হয়, ‘দাদার বদলে দাদী’র মতাে সম্ভাবনা তখন থাকবেই না। আর যুদ্ধ করে পাকিস্তান ভারতের মুসলমানদের হেফাজত করবে, তা কি সত্যই বিশ্বাস করা যায়? ভারতের মুসলমানদের কেউ কেউ নাকি পাকিস্তানকে হাতের পাঁচ মনে করে থাকেন। এখানে থাকা যখন একেবারেই অসম্ভব হয়ে পড়বে তখন তারা অন্তত পালিয়ে বাঁচার জায়গা পাবেন। এই পলায়নী মনােবৃত্তি বাংলাদেশের হিন্দুদের মধ্যেও বরাবর লক্ষ্য করা গেছে। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ভারত হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে বহিরাগতদের আত্মস্থ করে নেওয়ার নীতিতে বিশ্বাসী।
কিন্তু পাকিস্তানও কি ভারতের মুসলমানদের গ্রহণ করার জন্য বরণ ডালা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ১৯৬৪ সালের দাঙ্গার পর ভারত থেকে কয়েক হাজার মুসলমান পশ্চিম পাকিস্তানে আশ্রয় নিতে গেলে সেখানকার প্রশাসন যন্ত্র তাদের সাথে কেমন ব্যবহার করেছিল, সেকথা কি এত সহজে ভুলে যাওয়া যাবে? পশ্চিম পাকিস্তানের গভর্ণর সেইদিন স্পষ্ট ভাষায় বলে দিয়েছিলেন তার প্রদেশে নতুন কোনাে মােহাজেরকে তিনি স্থান দেবেন না। হতভাগ্য মানুষগুলােকে সেইদিন পশ্চিম পাকিস্তানের সীমান্ত থেকেই ফিরে যেতে হয়েছিল। বস্তুত ভারতের মুসলমানদের জন্য পশ্চিমা নেতারা যতই কুম্ভীরাশ্রত বর্ষণ করুক না কেন, বাস্তবে পশ্চিম পাকিস্তানের মাটিতে তারা কোনও বহিরাগতকে স্থান দিতে নারাজ। বাংলাদেশের পাঞ্জাবী গভর্ণর আজম খান যখন মাত্র কয়েক হাজার বাঙালি পরিবারকে পশ্চিম পাকিস্তানের মরুভূমিতে স্থান দিয়ে জাতীয় সংহতি’ দৃঢ়তর করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন তখন সমগ্র পশ্চিম পাকিস্তান তার বিরােধিতা করেছে এবং শেষ পর্যন্ত ঐসব হতভাগ্য কৃষক সর্বস্বান্ত হয়ে ভিক্ষাপাত্র হাতে পুনরায় বাংলাদেশে আসতে বাধ্য হয়েছেন। মনে রাখা দরকার পশ্চিম পাকিস্তান থেকে শিখ ও হিন্দুদের বিতাড়ন সম্পূর্ণ হবার পরেই ভারতের মুসলমানদের সাণে পশ্চিম পাকিস্তানীদের তথাকথিত ভারসাম্যেরও সমাপ্তি ঘটেছে। সেইদিক থেকেও বাংলাদেশেই এখন শেষ ভরসা। ভারতের মুসলমানদের নয়, বাংলাদেশেই নিহিত। কারণ, নিছক সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গিতেও যদি পরস্পর নির্ভরশীলতার প্রশ্ন ওঠে তবে তা ভারত ও বাংলাদেশের ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ। পশ্চিম পাকিস্তানের ভূমিকা এক্ষেত্রে অনেকটা ইরান বা আফগানিস্তানের ভূমিকার মতােই গৌণ।
স্বাধীন বাংলাদেশের অ্যুদয় উপমহাদেশের সাম্প্রদায়িক রাজনীতির অবসান। ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ মুসলমান সংখ্যায়িত হয়েও হিন্দুদের পরিপূর্ণ নাগরিক অধিকার প্রদানে প্রতিশ্রুতিবন্ধ। বাংলাদেশে হিন্দুরা সব অধিকার নিয়ে শান্তিতে বসবাস করলে ভারতের অভ্যন্তরেও সাম্প্রদায়িক শক্তির উন্মেষ শুদ্ধ হয়ে যাবে। ভারতও বাংলাদেশের মধ্যে স্বাভাবিক ভাবেই বন্ধুত্বের সম্পর্ক থাকবে। বাংলাদেশের উপনিবেশ হাতছাড়া হবার পর পাঞ্জাবী চক্রের যুদ্ধংদেহী মনােভাবও হাওয়া হয়ে যাবে এবং পশ্চিম পাকিস্তানের অভ্যন্তরেও বিবেকের কণ্ঠস্বর মাথা চাড়া দিয়ে উঠবে। বিশেষত সীমান্ত প্রদেশ বেলুচিস্থান ও সিন্ধুর মানুষের কাছে পাঞ্জাবী কায়েমী স্বার্থের ধর্মের জিগির তখন আর কোনাে আবেদন সৃষ্টি করবেনা। ফলে ভারত পাকিস্তান বেষারেষি নিত্যদিন সাম্প্রদায়িক উস্কানীর কারণ হয়ে দেখা দেবে না। ভারতের ধর্মীয় পুনরুজ্জীবনবাদীরাও তখন পাকিস্তান বিরােধী আক্রোশে ভারতীয় মুসলমানদের উপর খড়গহস্ত হবার কোনও বাহানা খুজে পাবে না। কৃত্রিম ভারসাম্যের পরিবর্তে পারস্পরিক সম্প্ৰতিতেই এই উপমহাদেশের সাম্প্রদায়িক সমস্যার সমাধান হতে টারে। বাংলাদেশ সেই সম্ভাবনা নিয়েই এসেছে। বলাবাহুল্য, স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশই হবে আগামী দিনে ভারতীয় মুসলমানদের নিরাপত্তার চাবিকাঠি।
সাপ্তাহিক বাংলা ।১:১১৬ সেপ্টেম্বর ১৯৭১
সূত্র : গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ – খন্ড – ১০