১৬ এপ্রিল ১৯৭১ মেজর আবু ওসমানের স্মৃতিচারণ
১৬ এপ্রিল যুগপৎভাবে পাক সেনাবাহিনী ও বিমানবাহিনী যশোর থেকে আমাদের উপর হামলা চালায়। এই দুই দিক থেকে (সামনে ও পিছন দিক থেকে) হামলা প্রতিহত করার মতো সৈন্যবল ও অস্ত্রবল আমার ছিলো না। কাজেই আমার সম্মুখভাগ (ফ্রন্ট লাইন) সঙ্কুচিত করার উদ্দেশ্যে দুই দিক থেকেই সৈন্যদের অপসারণ করে পিছিয়ে নিয়ে আসি পর্যায়ক্রমে এবং পুনঃপ্রতিরক্ষাব্যূহ গঠন করি কোটচাঁদপুর, ঝিনাইদহ, শৈলকুপা (রাস্তা), পোড়াদহ লাইনে। কিন্তু ১৬ই এপ্রিল অপরাহ্নেই পাকবাহিনীর হাতে ঝিনাইদহের পতন হয়।
এখানে একটা কথা বলে রাখা আবশ্যক যে, ১৬ই এপ্রিলে যখন দেখতে পেলাম সদর দপ্তর চুয়াডাঙ্গা থেকে সরিয়ে নিতে হবে, ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে তখনই নির্দেশ দিলাম সমস্ত স্থানীয় ও দূরবর্তী ব্যাংকের টাকা পয়সা সোনা গয়না সাথে নিয়ে নেয়ার জন্য। নির্দেশ অনুযায়ী ডাঃ আসহাবুল হক, ক্যাপ্টেন তৌফিক এলাহী, ক্যাপ্টেন মাহবুব এবং আরো কয়েকজন গণ্যমান্য লোকের প্রচেষ্টায় আনুমানিক সাড়ে চার কোটি টাকা ও আধা মণ সোনা আমরা সাথে নিয়ে যাই। স্থানীয় যত গুদামে চাউল ও আটা ছিলো সবগুলো আমাদের গাড়ীতে উঠিয়ে নেই।
১০ই এপ্রিল গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার গঠনের পর চুয়াডাঙ্গাকে বাংলাদেশের অস্থায়ী রাজধানী ঘোষণা করার সাথে সাথেই চুয়াডাঙ্গার উপরে চলতে থাকে তীব্র বিমান হামলা। এতদসত্ত্বেও বাংলাদেশ সরকার মনস্থীর করলেন যে চুয়াডাঙ্গার কোনো মুক্ত এলাকাতে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হবে ১৭ই এপ্রিল। নির্বাচন করা হলো আমারই পূর্বতন ইপিআর কোম্পানী হেডকোয়ার্টার বৈদ্যনাথতলার আম্রকানন। সময় সকাল ১০ ঘটিকা। আমি যুদ্ধে ওতপ্রোতভাবে লিপ্ত থাকা বিধায় স্টেজ ও আনুষ্ঠানিক ব্যবস্থাপনার ভার নিলেন ভারতীয় সীমান্ত রক্ষীবাহিনীর ৭৬ ব্যাটালিয়ন কমান্ডার লেঃ কর্নেল চক্রবর্তী। স্থানীয় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাও করলেন তিনি। আমাকে শুধু নির্দিষ্ট সময়ে উপস্থিত হবার জন্য খবর দেয়া হলো। ওদিকে প্রতিকুল পরিবেশের মধ্যে ঐ রাতেই সদর দপ্তর মেহেরপুর থেকে ভৈরব নদীর অপর পারে ইছাখালী বিওপি’তে স্থানান্তরিত করি। এই বিওপি থেকে ভারতীয় বিওপি’র দুরত্ব ছিলো প্রায় ৬০০ গজ। বিওপি’তে থাকবার মতো কোনো ব্যবস্থা না থাকায় সৈন্যদের যথাক্রমে প্লেস করিয়ে গাড়ীতে করে আমার স্ত্রী কন্যাদের নিয়ে এই প্রথমবারের মতো ভারতে পদার্পণ করি।
সে রাতে সামান্য একটা ঘটনার কথা কোনোদিন ভুলতে পারবো না। ঘটনাটা হলো এই যে, ভারতীয় মাটিতে পদার্পণ করার সাথে সাথেই আমার স্ত্রী নিজেকে অত্যন্ত অসহায় অনুভব করে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলেন। সাথে সাথে কন্যাদের অবস্থাও তথৈবচ। আমার স্ত্রী যতক্ষণ সম্ভব বাংলার মাটিতে কাটাবে বলে সিদ্ধান্ত নেয়। তাই ফিরে আসা হলো সেই ইছাখালীতে। বিওপি’র ভাঙ্গা ঘরে ছিলো না কোনো বিছানাপত্র, ছিলো না কোনো শোবার জায়গা। মাটিতে শুয়ে ওরা রাত কাটিয়ে দিলো।