জিয়া কেন বলেছিলো, “আই উইল মেইক পলিটিক্ষ ডিফিকাল্ট?”
জিয়ার আমলে ভাসানীর ভূমিকা কী?
বিচারপতি সায়েমের ক্ষমতা কীভাবে খর্ব করা হয়?
এয়ার ভাইস মার্শাল খাদেমুল বাশার হত্যাকাণ্ড
১. ১৯৭৬ সনের নভেম্বরের মধ্যে রাজনৈতিক দলবিধির শর্তমালা পূরণ করে ৫৬ টি দল অনুমােদনের জন্য আবেদন করে। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, বাংলাদেশ কমিউনিষ্ট পার্টি, ডেমােক্রেটিক লীগ, জাতীয় লীগ, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি সহ। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ঘােষিত সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবী জানাতে থাকে। প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক বিচারপতি আবু সাদাত মােহাম্মদ সায়েম এই লক্ষ্যে ১৯৭৫ সনের ৮ই নভেম্বর জারীকৃত এবং জাতির নিকট ওয়াদা বদ্ধ ১৯৭৭ সনের ফেব্রুয়ারী মাসের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে এগিয়ে যেতে থাকেন। বিচারপতি সায়েম নিজেই বলেছেন যে, তার সরকার অন্তবর্তীকালীন সরকার। তঁাকে সাহায্য করার জন্য একটি উপদেষ্টা পরিষদ গঠিত হয়েছিলাে এবং তাদের দায়িত্ব ছিলাে সরকারের দৈনন্দিন কাজসমূহ এগিয়ে নেয়া মাত্র। তারা মন্ত্রীদের মর্যাদা এবং পতাকা বহন করতে পারতেন না।
২. নির্বাচন বানচাল করার লক্ষ্যে জিয়াউর রহমানের সূক্ষ্ম, গােপনীয় ও লক্ষ্যাভিসারী পদক্ষেপগুলাে গণতন্ত্র উত্তরণের পক্ষে বাধা সৃষ্টি করে। জিয়াউর রহমান নির্বাচন অনুষ্ঠান সংক্রান্ত বিষয়ে প্রকাশ্যে ও বাহ্যতঃ যত অঙ্গীকারই করুন না কেন ৭ই নভেম্বর ৭৫ সনের ঘােষিত সামরিক প্রধানের পদটি পুনরায় দখল এবং সুযােগমত প্রেসিডেন্ট পদটিও করায়াত্ত বিষয়ে শিকারী বাঘের মতই এগিয়ে আসছিলেন। ঘােষিত ১৯৭৭ সনের ফেব্রুয়ারী মাসের মধ্যে পার্লামেন্ট নির্বাচন সংক্রান্ত অঙ্গীকার বানচাল করার লক্ষ্যে জিয়াউর রহমান সর্পিণ সন্তর্পনে এগিয়ে যাচ্ছিলেন। অর্থ, স্বরাষ্ট্র ও তথ্য, শিল্প, বাণিজ্য, শিক্ষা, প্রতিরক্ষা দপ্তরের দায়িত্ব প্রাপ্ত জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবু সায়েম মােঃ সায়েমের ক্ষমতাকে সুপারসিড করে রাষ্ট্রপরিচালনায় মুখ্য ব্যক্তি হিসেবে জাতির সামনে নিজেকে উপস্থাপিত করেন। জাতীয় ও রাষ্ট্রীয় জীবনের প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ও দিবসে প্রেসিডেন্টের ভাষণের পাশাপাশি মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান পৃথকভাবে রেডিও টিভিতে ভাষণ দান শুরু করেন। এমনকি, নীতি নির্ধারণী বিষয় যা রাষ্ট্রপতির ভাষণে প্রতিফলিত হওয়ার কথা। সে সম্পর্কেও প্রেসিডেন্টের আওতাকে অগ্রাহ্য করে বলতে গেলে চ্যালেঞ্জ করে, ভাষণ বিবৃতি প্রচার করতে থাকেন। যদিও শাসনতান্ত্রিক প্রশ্নে দেশে প্রেসিডেন্টশিয়াল পদ্ধতি বহাল ছিলাে।
৩. অত্যন্ত সূক্ষভাবে সামরিক এক ফরমান বলে সামরিক প্রধান ও প্রেসিডেন্ট আবু মােহাম্মদ সায়েমের বিদেশ ভ্রমণকালে কে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের দায়িত্ব পালন করবেন তাও ঘােষণা করা হয়। এবং জিয়াউর রহমান সে স্থলে স্থলাভিষিক্ত হবার পথ সুগম করেন। প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের পদ ও ক্ষমতার সীমাহীন স্বাদ গ্রহণ করতে সমর্থ হন। এরপর হতেই জিয়াউর রহমান প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্যে কিংবা প্রত্যক্ষ বা পরােক্ষভাবে ক্ষমতা দখলের জন্য মরিয়া হতে ওঠেন। ক্ষমতা দখলের জন্য স্বাধীনতা বিরােধী চক্র ও চৈনিকপন্থী উগ্র দলগুলােকে রাজনৈতিক দাবার ঘুটি হিসেবে রাজনৈতিক আসরে নামিয়ে দেন। ৪. জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক জাতীয় দল বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ ঘােষণা করলে মওলানা ভাসানী শোষণ মুক্ত দেশ গঠনে শেখ মুজিবের পদক্ষেপকে স্বাগত এবং বঙ্গবন্ধুকে দোয়া করেন। ১৯৭৫ সনের ১৫ই আগস্ট জাতির জনক ও নির্বাচিত সরকার প্রধান রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবকে নৃশংসভাবে হত্যা করার পর খন্দকার মােশতাক ক্ষমতা দখল করলে মওলানা ভাসানী মােশতাককে অভিনন্দন জানান। মােশতাককে হটিয়ে প্রকাশ্যে বিচারপতি সায়েম নেপথ্যে কূটবুদ্ধি সম্পন্ন জিয়াউর রহমান ক্ষমতা প্রয়ােগের প্রধান ব্যক্তি হয়ে দাঁড়ালে মওলানা ভাসানী জিয়াউর রহমানের দিকে ঝুঁকে পরেন। জিয়াউর রহমানের পৃষ্টপােষকতায় মওলানা ভাসানী দেশের মধ্যে স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব রক্ষায় ভারত বিদ্বেষকে উসকে দেবার কৌশল গ্রহণ করেন। এবং এই লক্ষ্যে মওলানা ভাসানী ১৬ই মে ‘৭৬ ফারাক্কা মিছিলের আয়ােজন করেন। দেশে তখন সামরিক আইন ও শাসন বলবৎ। সর্বপ্রকার মিটিং মিছিল নিষিদ্ধ। তার মধ্যে মওলানা ভাসানী সামরিক ফরমান ভঙ্গ করে মিটিং মিছিল কিভাবে করতে পেরেছেন? সামরিক শাসক জিয়া চক্রের সহযােগিতা ব্যতীত এটি কি আদৌও সম্ভবপর ছিলাে? ফারাকা সমস্যা আমাদের জাতীয় সমস্যা সন্দেহ নেই, নির্বাচিত সরকারই কেবলমাত্র এই গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় ইস্যুটি দ্বিপাক্ষিক ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সমাধান করতে সক্ষম। একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পক্ষে এই জটিল সমস্যা সমাধান যে সম্ভবপর নয় একথা মওলানা ভাসানীর মতাে রাজনীতিবিদদের অজানা নয়। ১৯৫৮ সালে পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারী হলে শহীদ সােহরাওয়ার্দীর একমাত্র শ্লোগান ছিলাে- ‘সবার আগে গণতন্ত্র চাই।” সামরিক শাসনের অবসান চাই। মওলানা ভাসানী দেশে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং সামরিক শাসনের বলয় থেকে দেশকে উদ্ধারের পরিবর্তে জাতীয় জীবনের বহুবিধ সমস্যার মধ্যে কেবলমাত্র। ফারাক্কা ইস্যুকে প্রধান ও একমাত্র ইস্যু করার ক্ষেত্র নির্ণয়ে রাজনৈতিক বিশেষ উদ্দেশ্য প্রণােদনাই ছিলাে মুখ্য। ফারাক্কা ইস্যু ও মিছিলের মূল লক্ষ্য ছিলাে রাজনৈতিক। সে রাজনীতি স্বাধীনতা বিরােধী শক্তিকে প্রকাশ্য আসতে ও ঐক্যবদ্ধ করতে সাহায্য করেছে। ভারত বিরােধীতার আবরণে আওয়ামী লীগ বিরােধী রাজনীতিকে বাংলাদেশের নিরীহ মানুষের মনে এথিত করার সুদূরপ্রসারী পদক্ষেপ হিসেবে জিয়াউর রহমানের। ছকেই মওলানা ভাসানী পা দিয়েছিলেন- যেমন অতীতেও ‘ডােন্ট ডিস্টার্ব আইয়ুব’ বলে বাংলার জনগণের দাবীকে পাশ কাটিয়ে কাশ্মীর ইস্যুকেই বড় করে ধরেছিলেন। ঘােষিত পার্লামেন্ট নির্বাচনকে সামনে রেখে যেখানে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে কার্যকর ও অর্থবহ করার লক্ষ্যে তঁার উদ্যোগ ছিলাে অপরিহার্য, সেক্ষেত্রে মওলানা ভাসানী জিযার পরিকল্পিত প্রিন্ট অনুসারেই কাজ করেছেন মাত্র। জাতির জনক ও জাতীয় চার নেতার অবর্তমানে মওলানা ভাসানী জাতীয় নেতার গুরু দায়িত্ব পালনে সক্ষম হলেন না। এটা ছিলাে জাতীয় জীবনে দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা। ১৯৭৭ সনের ফেব্রুয়ারী মাসের অনুষ্ঠিতব্য পার্লামেন্ট নির্বাচন সম্পর্কে মওলানা ভাসানীর মন্তব্য। ছিলাে “দেশে অনুকূল পরিবেশ থাকলে নির্বাচন হবে। এটা ছিলাে প্রকৃত পক্ষে নির্বাচন বিরােধী চক্রের প্রতিধ্বনি মাত্র। জিয়াউর রহমানের নির্বাচন স্থগিত প্রক্রিয়ায় সাহায্যে মওলানা ভাসানী অন্য এক বিবৃতিতে বললেন “দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নির্বাচনী পরিবেশের উপযােগী নয়। বরং জনগণ এই মুহূর্তে নির্বাচন চায় না। জনগণ নির্বাচন চায় কি চায় না সে ব্যাপারে গণভােট অনুষ্ঠান নেয়া হােক। তাছাড়া অতীতেও জনগণ নির্বাচনের মাধ্যমে কোন প্রকার লাভবান হয়নি। জিয়াউর রহমানের চীন সফরের ব্যবস্থা ঠিকঠাক হয়ে গেলে মওলানা ভাসানী আরাে এক ধাপ এগিয়ে গিয়ে বলেন, “তিনি এই মুহূর্তে জাতিকে বিভক্ত করতে চান না, নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলেই জাতি বিভক্ত হয়ে যাবে। তাই আপাততঃ নির্বাচন স্থগিত রেখে সামরিক শাসন বজায় রাখা হােক।”
৫. নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের জন্য প্রেসিডেন্ট সায়েম নির্বাচন কমিশনকে ভােটার লিস্ট তৈরি করার আদেশ প্রদান করেছিলেন। ভােটার লিস্ট তৈরীও হয়েছিলাে-যার ভিত্তিতে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনও অনুষ্ঠিত হয়েছিলাে। কিন্তু ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের গােপন রিপাের্টে জিয়ার নিকট পরিস্কার হয়ে গেলাে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীরাই শতকরা ৬০%টি আসন দখল করেছে। ঐ নির্বাচনে বামডান চীনপন্থী ও মুসলিম লীগের গণভক্তির বিচ্ছিন্নতা প্রমাণ হওয়ার পর জিয়াউর রহমানের নিকট ১৯৭৭ সনে ফেব্রুয়ারি মাসের নির্বাচন স্থগিত বা বাতিল করা ব্যতীত অন্য কোন বিকল্প রাস্তা খােলা ছিল না।৬ ৬. গণবিচ্ছিন্ন চৈনিকপন্থী দল, গােষ্ঠী ও ব্যক্তি মিলে জাতীয় প্রতিরােধ কমিটি গঠন করে এবং রুশ-ভারতের দালালদের নিশ্চিহ্ন করার লক্ষ্যে বিপ্লবী শ্লোগান তােলে। সামরিক শাসনের কড়া সেন্সরশীপের মধ্যেও আওয়ামী-বাকশালী ও “রুশ-ভারতের কথিত দালালদের বিরুদ্ধে উচ্চকণ্ঠ বৈপ্লবিক লড়াইয়ের ভাষা প্রচারিত হতে বাধা পায়নি। স্বাধীনতার বিরােধীতাকারী এসব চৈনিক’গ্রুপ আন্ডার গ্রাউন্ড রাজনৈতিক নেট ওয়ার্কের মাধ্যমে ৭৫ সনের ১৫ আগস্ট পূর্ববর্তী সময়ে সশস্ত্র বিপ্লবের কর্মসূচী গ্রহণ করে। সমগ্র দেশে খতমের রাজনীতি শুরু করে। ‘মুসলিম বাংলার’ শ্লোগান তােলে। মুসলিম বাংলা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টোর নিকট অর্থ ও অস্ত্র সাহায্য প্রার্থনা করে।৭ জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর এসব চৈনিক পন্থী উল বিপ্লবীগণ প্রকাশ্য রাজনীতিতে আবির্ভূত হয়। এবং ঘােষিত ১৯৭৭ সনের ফেব্রুয়ারী মাসের নির্বাচনের বিরােধীতা করে। জেনারেল জিয়াউর রহমানের সঙ্গে বৈঠক ও আঁতাত করে নির্বাচন বানচালের জন্য জাতীয় প্রতিরােধ কমিটি’ নামে তথাকথিত কমিটি গঠন করে। জাতীয় প্রতিরােধ কমিটির শরীক দলগুলাে সর্বদা নির্বাচন বিরােধীতা করে এসেছে। আসলে তারা নির্বাচনেই বিশ্বাস করেন না। নির্বাচন এলেই তারা ভােটের বাক্সে লাথি মেরে ভাত দাবি করেন। এটাই তাদের রাজনীতি। জাতীয় প্রতিরােধ কমিটি’ রুশ-ভারত ও আওয়ামী বাকশালীদের প্রতিরােধ করতে গিয়ে প্রকারান্তরে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ও গণতন্ত্রকেই প্রতিরােধ করেছে। চীনপন্থী ও পাকিস্তান পন্থী গ্রুপ সামরিক সরকারের নেপথ্য শক্তিধর ব্যক্তি জিয়াউর রহামনের হাতের ক্রীড়নক হয়ে নির্বাচন বানচালের ষড়যন্ত্রমূলক খেলায় উঠেছিলাে। নির্বাচনকে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সামরিক শাসনের যাঁতাকলে নিষ্পেষিত জাতির জন্য, গণতন্ত্রে উত্তরণের প্রয়ােজনে নির্বাচন যে ক্ষেত্রে ছিল অপরিহার্য, সেক্ষেত্রে জিয়ার ছকে পা দিয়ে মার্শাল ল প্রলম্বিত করার ঘৃণ্য তৎপরতায় তােয়াহা সাহেব, ছিলেন চক্রান্তে লিপ্ত।
৭. জনাব সায়েম বলেছেন, তার উপদেষ্টাগণ বিশেষ করে দেশে দ্রুত গণতান্ত্রিক পরিবেশ, দলগঠন নির্বাচন ও নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তরে জন্য রাষ্ট্রপতির বিশেষ সহকারী হিসেবে বিচারপতি আবদুস সাত্তার যাকে বিশ্বাস ও আস্থার সঙ্গে উপরােক্ত লক্ষ্য সাধনের জন্য নিয়ােগ দান করেছিলেন তিনিও ঐ চক্রান্তের অংশীদার হয়ে নির্বাচন পিছিয়ে দেবার পক্ষে ছিলেন। রাষ্ট্রপতি বলছিলেন, দেশে রাজনৈতিক শূন্যতা বিরাজ করছে। অন্যদিকে উপদেষ্টাদের মধ্যে অনেকেই তখন বলে চলেছিলেন দেশে রাজনৈতিক শূন্যতা নেই। অর্থাৎ রাজনীতি বন্ধ করার পর সামরিক শাসনের মধ্যেও কি করে রাজনৈতিক শূন্যতা থাকে না তা বােধগম্য হলেও এটা পরিষ্কার হয়ে আসছিলাে যে জিয়াউর রহমান সরকারী খরচে হেলিকপ্টার, যানবাহন, টিভি, রেডিও-ও প্রচার মাধ্যমে রাজনৈতিক নেতৃত্বের ভূমিকায় জোরেশােরেই অবতীর্ণ হয়েছিলেন। যদিও রাজনৈতিকভাবে নেতা কর্মীদের গ্রেফতার করা হচ্ছিল নির্বিচারে। ১৯৭৬ সনের ৮ই জানুয়ারি সামরিক ফরমান জারি করে বলা হয়েছিলাে, বক্তব্য, লেখনি, স্বাক্ষর বা প্রতীক দ্বারা যেভাবেই হােক না কেন সামরিক শাসন জারী, বলবৎ থাকা নিয়ে প্রধান সামরিক প্রশাসক বা ডেপুটি সামরিক প্রশাসক বা সামরিক কর্তৃপক্ষের কার্যক্রমের বিরুদ্ধে কথা বললে দশ বছর পর্যন্ত সাজা হতে পারে। [পরিশিষ্ট-৭] এই ফরমান জারির মূল লক্ষ্য ছিলাে, আওয়ামী লীগসহ স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি যেন মাঠে নামতে না পারে।
৮. দেশ গণতন্ত্রের পথে স্বাভাকিভাবে অগ্রসর হােত জিয়াউর রহমানের নিকট ছিল তা অনাকাঙ্খিত। গণতন্ত্রের গতিরুদ্ধ করা হয়েছে বারবার। তথ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকা অবস্থায় ১৯৭৬ সনের ৩রা অক্টোবর জিয়াউর রহমান কড়া মার্শাল ল’-এর মধ্যে ভয়েস অব আমেরিকার প্রতিনিধি মিঃ ওয়েন কোরকে বাংলাদেশে নিয়ে আসেন। প্রচুর উপঢৌকন, খানাপিনা এবং হােটেল ইন্টারকনের আরামদায়ক কক্ষে অবস্থান করে তিনি ভােয়া থেকে প্রচারিত এক প্রতিবেদন উল্লেখ করেন যে, “বাংলাদেশের জনগণ এক্ষুণি নির্বাচন চায় না, নির্বাচনের প্রয়ােজন নেই। প্রতিবেদনে বলা হয় সামরিক শাসনে জনগণ ভালাে আছে, জনগণ হারাবার ঝুঁকি নিতে চায় না। ৯
৯. বিচারপতি সায়েম একাকী হয়ে পড়েন। তার উপদেষ্টাগণও বঙ্গভবনে আসার চাইতে আর্মি হেডকোয়ার্টারে দৌড়ানােতে স্বাচ্ছন্দ্যরােধ করেন। আওয়ামী লীগ ব্যতীত চীন-পাকিস্তানপন্থী রাজনৈতিক দলগুলাের নেতৃবৃন্দ ক্যান্টনমেন্টের দিকে ছুটতে থাকেন। জিয়াউর রহমান দেখলেন নির্বাচন বন্ধ না করতে পারলে তার ক্ষমতার পথ চিরতরে রুদ্ধ হয়ে পড়বে। কালবিলম্ব না করে জিয়াউর রহমান ২৯শে নভেম্বর ৭৬ সনে প্রধান সামরিক পদটি বিচারপতি সায়েমের নিকট কেড়ে নেন। অসহায় বিচারপতির করুণ নিঃশব্দ আত্মনা তার বইয়ের বিবরণীতে প্রকাশিত হয়েছে। ১০দেশে মার্শাল ল জারি থাকার প্রেক্ষিতে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের পদটি কেড়ে নেওয়ার ফলে সায়েম ‘ফুটো জগন্নাথ’ হিসেবে কেবলমাত্র রাষ্ট্রপতির পদটিতে বহাল থাকলেন মাত্র।
১০, বিচারপতি সায়েম জিয়াউর রহমানের উচ্চাভিলাষ এবং দেশকে গণতন্ত্রের পথে এগিয়ে নিয়ে যাবার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করার কারণে জেনারেল জিয়াকে। সরিয়ে সেনাবাহিনীর প্রধান হিসেবে নতুন কোন সামরিক ব্যক্তিত্বকে নিয়ােগ দানের কথা ভাবছিলেন। এয়ার ভাইস মার্শাল বাশারেরও এতে সম্মতি ছিলাে। বলাবাহুল্য, এয়ার ভাইস মার্শাল বাশার বিমানবন্দরে এক রহস্যময় বিমান দুর্ঘটনায় নিহত হন। মুক্তিযােদ্ধা মােহাম্মদ খাদেমুল বাশারের নিহত হওয়ার রহস্য। জিযার জীবদ্দশায় কেন, আজ পর্যন্ত জনসাধারণ জানতে পারেনি।
১১. ১৯৭৬ সনেই জিয়ার রহমান এয়ার ভাইস মার্শাল এম জি তােয়াবকে সরিয়ে দেয়। কেননা সেনাবাহনিীর আর্টিলারী ফিল্ড রেজিমেন্ট ও ট্যাংক রেজিমেন্টসহ পদাতিক বাহিনীর উল্লেখযােগ্য অংশ তােয়াবকে সমর্থন করে যাচ্ছিলাে এবং তােয়াব ক্রমান্বয়ে তার অবস্থান দৃঢ় করতে প্রয়াস পাচ্ছিলাে। জিয়া অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে নির্মম নিষ্ঠুরতার সঙ্গে তার পথের কাটা সরিয়ে দিতে দ্বিধা করেনি।১১
১২. এই অবস্থার মধ্যেও প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক বিচারপতি আবু সাদাত মােহাম্ম। সায়েম দেশে দ্রুত রাজনৈতিক প্রক্রিয়া শুরু করার লক্ষ্যে ১৯৭৬ সনের ১১ই আগস্ট সামরিক ফরমান জারি করে হাইকোর্ট বিভাগে সংক্ষুদ্ধ ব্যক্তিদের আইনে আশ্রয় লাভের অধিকারের গ্যারান্টি প্রদান করেন। সেই সুবাদে গ্রেফতারকৃত আওয়ামী লীগ নেতা বেগম সাজেদা চৌধুরী, সালাহউদ্দিন ইউসুফ, আবদুল মমিন তালুকদারসহ বিভিন্ন নেতৃবৃন্দের মুক্তির লক্ষ্যে হাইকোর্টে রীট পিটিশন দায়ের করা সম্ভব হয়েছিলাে। যা ইতিপূর্বে সামরিক ফরমান বলে নিষিদ্ধ ছিলাে।
১৩. জিয়াউর রহমান জাতীয় প্রতিরােধ কমিটির নেতাদের দিয়ে নির্বাচন পিছানাের দাবি তুলে তাদের হাত থেকে নিজের হাতে বলটি তুলে নেন। ইতিপূর্বে নির্বাচন অনুষ্ঠান ঘােষণার মাধ্যমে যা ছিলাে জিয়াউর রহমানের হাতের নাগালের বাইরে। জিয়াউর রহমান তার দক্ষ গােয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে ভালাে করেই জানতেন প্রতিরােধ কমিটি নেতারা নির্বাচনে বিশ্বাস করে না। সেজন্য নির্বাচন পেছানাের দাবি তাদের দ্বারা সহজেই গেলানো সম্ভব। ১৯৭৭ সনের ফেব্রুয়ারী মাসের সাধারণ নির্বাচন স্থগিত ঘােষনার পর চৈনিকপন্থীদের ‘মগজ’ নামে খ্যাত জনাব এনায়েত উল্লাহ খান এক সাক্ষাৎকারে বলেন, “জাতীয় প্রতিরােধ কমিটির আর প্রয়ােজন নাই।” “দেশে রাজনৈতিক শূন্যতা চলছে।” অপর এক প্রশ্নের উত্তরে জনাব এনায়েত উল্লাহ খান বলেন, বর্তমান সরকারকে কোন অবস্থাতেই অন্তবর্তীকালীন সরকার বলে উল্লেখ করা যায় না। কেননা, তারা এই মুহূর্তে ক্ষমতা হস্তান্তর করছেন না। তিনি বলেন, “আওয়ামী লীগ ও সিপিবি দেশের প্রধান শক্র। কেননা তারা ১৯৭৫ সনের ১৫ই আগষ্টের ঐতিহাসিক পরিবর্তনকে আজো মেনে নেয়নি। তিনি বলেন, সরকার জাতীয় কনভেনশন নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করছেন।১২
১৪. জনাব আতাউর খানের জাতীয় লীগের পক্ষ হতে জাতীয় লীগের জনাব আবুল কাশেম নির্বাচন স্থগিত করার দাবি জানিয়ে এক বিবৃতি দেন। বিবৃতিটি সরকারী প্রচার মাধ্যমে ফলাও করে প্রচার করা হয়। ৭৭-এর ফেব্রুয়ারীতে যথাসময়ে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে জাতীয় ঐক্য ও সংহতি বিপন্ন হয়ে পড়বে’- এ মর্মে জাতীয় প্রতিরােধ কমিটিও অনুরূপ বিবৃতি প্রদান করে। জনাব আতাউর রহমান খান যথাসময়ে নির্বাচন প্রদানে দাবি এত বেশী করেছেন যে, এখন তিনি নিঃশ্রুপ। এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন-“প্রদত্ত বিবৃতিই তার পার্টির মতামত।” স্বাধীনতা বিরােধী চক্রের অন্যতম হােতা মওলানা মতিন আরও এক ধাপ এগিয়ে গিয়ে বলেন, ‘নির্বাচন দিলে তিনি ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাও করবেন।’১৩ জিয়াউর রহমান এসব রাজনীতিবিদদের কাজে লাগিয়ে কাগুজে পরিস্থিতি সৃষ্টিকরে ১৯৭৭ সনের ফেব্রুয়ারীর মধ্যে অনুষ্ঠিতর ও প্রতিশ্রুত পার্লামেন্ট নির্বাচন স্থগিত ঘােষণা করতে বিচারপতি সায়েমকে বাধ্য করলেন। প্রতিশ্রুত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার গতিরুদ্ধ হয়ে গেলাে।
১৫. বিচারপতি সায়েম ১৯৭৫ ১৯৭৫ সনের ৬ই নভেম্বর ক্ষমতা গ্রহণের পর নির্বাচিত জাতীয় সংসদ ভেঙে দেন-যদিও এই জাতীয় সংসদের মেয়াদ ছিলাে আরাে ৪ বছর। সেই সময় তিনি প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সামরিক প্রশাসক হিসেবে জাতিকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন ‘৭৭ সনের ফেব্রুয়ারী মাসের মধ্যে পার্লামেন্ট নির্বাচন সম্পন্ন করবেন। প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের পদ থেকে বিচারপতি আবু সাদতমােঃ সায়েমকে অস্ত্রের মুখে তাড়িয়ে দিয়ে মেজর জেনারেল জিয়া প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের পদ ও ক্ষমতা দখল করে ঘােষণা দেন যে, প্রেসিডেন্ট, প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে এবং তার প্রতি জনগণের আস্থা আছে কিনা? অর্থাৎ মেজর জেনারেল জিয়া দেশে পার্লামেন্টারী গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পরিবর্তে প্রেসিডেন্টশিয়াল পদ্ধতি বহাল রাখার পক্ষে অগ্রসর হলেন।
জিয়াউর রহমানের নির্বাচনী’ সার্কাস হাঁ/না ভােট শেষ হওয়ার পর পূর্ব প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী পার্লামেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা। কিন্তু জিয়াউর রহমান সে পথে অগ্রসর হলেন না। অত্যন্ত গােপনে তিনি প্রেসিডেন্ট পদ্ধতি বহাল ও প্রেসিডেন্ট নির্বাচন জন্য অগ্রসর হতে থাকেন।
Reference: জেনারেল জিয়ার রাজত্ব -অধ্যাপক আবু সাইদ
ভিডিও – খাদেমুল বাশারের রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন
আই উইল মেইক পলিটিক্ষ ডিফিকাল্ট
জিয়া কেন বলেছিলো, "আই উইল মেইক পলিটিক্ষ ডিফিকাল্ট?"জিয়ার আমলে ভাসানীর ভূমিকা কী?বিচারপতি সায়েমের ক্ষমতা কীভাবে খর্ব করা হয়?এয়ার ভাইস মার্শাল খাদেমুল বাশার হত্যাকাণ্ড১. ১৯৭৬ সনের নভেম্বরের মধ্যে রাজনৈতিক দলবিধির শর্তমালা পূরণ করে ৫৬ টি দল অনুমােদনের জন্য আবেদন করে। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, বাংলাদেশ কমিউনিষ্ট পার্টি, ডেমােক্রেটিক লীগ, জাতীয় লীগ, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি সহ। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ঘােষিত সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবী জানাতে থাকে। প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক বিচারপতি আবু সাদাত মােহাম্মদ সায়েম এই লক্ষ্যে ১৯৭৫ সনের ৮ই নভেম্বর জারীকৃত এবং জাতির নিকট ওয়াদা বদ্ধ ১৯৭৭ সনের ফেব্রুয়ারী মাসের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে এগিয়ে যেতে থাকেন। বিচারপতি সায়েম নিজেই বলেছেন যে, তার সরকার অন্তবর্তীকালীন সরকার। তঁাকে সাহায্য করার জন্য একটি উপদেষ্টা পরিষদ গঠিত হয়েছিলাে এবং তাদের দায়িত্ব ছিলাে সরকারের দৈনন্দিন কাজসমূহ এগিয়ে নেয়া মাত্র। তারা মন্ত্রীদের মর্যাদা এবং পতাকা বহন করতে পারতেন না।২. নির্বাচন বানচাল করার লক্ষ্যে জিয়াউর রহমানের সূক্ষ্ম, গােপনীয় ও লক্ষ্যাভিসারী পদক্ষেপগুলাে গণতন্ত্র উত্তরণের পক্ষে বাধা সৃষ্টি করে। জিয়াউর রহমান নির্বাচন অনুষ্ঠান সংক্রান্ত বিষয়ে প্রকাশ্যে ও বাহ্যতঃ যত অঙ্গীকারই করুন না কেন ৭ই নভেম্বর ৭৫ সনের ঘােষিত সামরিক প্রধানের পদটি পুনরায় দখল এবং সুযােগমত প্রেসিডেন্ট পদটিও করায়াত্ত বিষয়ে শিকারী বাঘের মতই এগিয়ে আসছিলেন। ঘােষিত ১৯৭৭ সনের ফেব্রুয়ারী মাসের মধ্যে পার্লামেন্ট নির্বাচন সংক্রান্ত অঙ্গীকার বানচাল করার লক্ষ্যে জিয়াউর রহমান সর্পিণ সন্তর্পনে এগিয়ে যাচ্ছিলেন। অর্থ, স্বরাষ্ট্র ও তথ্য, শিল্প, বাণিজ্য, শিক্ষা, প্রতিরক্ষা দপ্তরের দায়িত্ব প্রাপ্ত জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবু সায়েম মােঃ সায়েমের ক্ষমতাকে সুপারসিড করে রাষ্ট্রপরিচালনায় মুখ্য ব্যক্তি হিসেবে জাতির সামনে নিজেকে উপস্থাপিত করেন। জাতীয় ও রাষ্ট্রীয় জীবনের প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ও দিবসে প্রেসিডেন্টের ভাষণের পাশাপাশি মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান পৃথকভাবে রেডিও টিভিতে ভাষণ দান শুরু করেন। এমনকি, নীতি নির্ধারণী বিষয় যা রাষ্ট্রপতির ভাষণে প্রতিফলিত হওয়ার কথা। সে সম্পর্কেও প্রেসিডেন্টের আওতাকে অগ্রাহ্য করে বলতে গেলে চ্যালেঞ্জ করে, ভাষণ বিবৃতি প্রচার করতে থাকেন। যদিও শাসনতান্ত্রিক প্রশ্নে দেশে প্রেসিডেন্টশিয়াল পদ্ধতি বহাল ছিলাে।৩. অত্যন্ত সূক্ষভাবে সামরিক এক ফরমান বলে সামরিক প্রধান ও প্রেসিডেন্ট আবু মােহাম্মদ সায়েমের বিদেশ ভ্রমণকালে কে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের দায়িত্ব পালন করবেন তাও ঘােষণা করা হয়। এবং জিয়াউর রহমান সে স্থলে স্থলাভিষিক্ত হবার পথ সুগম করেন। প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের পদ ও ক্ষমতার সীমাহীন স্বাদ গ্রহণ করতে সমর্থ হন। এরপর হতেই জিয়াউর রহমান প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্যে কিংবা প্রত্যক্ষ বা পরােক্ষভাবে ক্ষমতা দখলের জন্য মরিয়া হতে ওঠেন। ক্ষমতা দখলের জন্য স্বাধীনতা বিরােধী চক্র ও চৈনিকপন্থী উগ্র দলগুলােকে রাজনৈতিক দাবার ঘুটি হিসেবে রাজনৈতিক আসরে নামিয়ে দেন। ৪. জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক জাতীয় দল বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ ঘােষণা করলে মওলানা ভাসানী শোষণ মুক্ত দেশ গঠনে শেখ মুজিবের পদক্ষেপকে স্বাগত এবং বঙ্গবন্ধুকে দোয়া করেন। ১৯৭৫ সনের ১৫ই আগস্ট জাতির জনক ও নির্বাচিত সরকার প্রধান রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবকে নৃশংসভাবে হত্যা করার পর খন্দকার মােশতাক ক্ষমতা দখল করলে মওলানা ভাসানী মােশতাককে অভিনন্দন জানান। মােশতাককে হটিয়ে প্রকাশ্যে বিচারপতি সায়েম নেপথ্যে কূটবুদ্ধি সম্পন্ন জিয়াউর রহমান ক্ষমতা প্রয়ােগের প্রধান ব্যক্তি হয়ে দাঁড়ালে মওলানা ভাসানী জিয়াউর রহমানের দিকে ঝুঁকে পরেন। জিয়াউর রহমানের পৃষ্টপােষকতায় মওলানা ভাসানী দেশের মধ্যে স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব রক্ষায় ভারত বিদ্বেষকে উসকে দেবার কৌশল গ্রহণ করেন। এবং এই লক্ষ্যে মওলানা ভাসানী ১৬ই মে '৭৬ ফারাক্কা মিছিলের আয়ােজন করেন। দেশে তখন সামরিক আইন ও শাসন বলবৎ। সর্বপ্রকার মিটিং মিছিল নিষিদ্ধ। তার মধ্যে মওলানা ভাসানী সামরিক ফরমান ভঙ্গ করে মিটিং মিছিল কিভাবে করতে পেরেছেন? সামরিক শাসক জিয়া চক্রের সহযােগিতা ব্যতীত এটি কি আদৌও সম্ভবপর ছিলাে? ফারাকা সমস্যা আমাদের জাতীয় সমস্যা সন্দেহ নেই, নির্বাচিত সরকারই কেবলমাত্র এই গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় ইস্যুটি দ্বিপাক্ষিক ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সমাধান করতে সক্ষম। একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পক্ষে এই জটিল সমস্যা সমাধান যে সম্ভবপর নয় একথা মওলানা ভাসানীর মতাে রাজনীতিবিদদের অজানা নয়। ১৯৫৮ সালে পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারী হলে শহীদ সােহরাওয়ার্দীর একমাত্র শ্লোগান ছিলাে- ‘সবার আগে গণতন্ত্র চাই।” সামরিক শাসনের অবসান চাই। মওলানা ভাসানী দেশে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং সামরিক শাসনের বলয় থেকে দেশকে উদ্ধারের পরিবর্তে জাতীয় জীবনের বহুবিধ সমস্যার মধ্যে কেবলমাত্র। ফারাক্কা ইস্যুকে প্রধান ও একমাত্র ইস্যু করার ক্ষেত্র নির্ণয়ে রাজনৈতিক বিশেষ উদ্দেশ্য প্রণােদনাই ছিলাে মুখ্য। ফারাক্কা ইস্যু ও মিছিলের মূল লক্ষ্য ছিলাে রাজনৈতিক। সে রাজনীতি স্বাধীনতা বিরােধী শক্তিকে প্রকাশ্য আসতে ও ঐক্যবদ্ধ করতে সাহায্য করেছে। ভারত বিরােধীতার আবরণে আওয়ামী লীগ বিরােধী রাজনীতিকে বাংলাদেশের নিরীহ মানুষের মনে এথিত করার সুদূরপ্রসারী পদক্ষেপ হিসেবে জিয়াউর রহমানের। ছকেই মওলানা ভাসানী পা দিয়েছিলেন- যেমন অতীতেও ‘ডােন্ট ডিস্টার্ব আইয়ুব’ বলে বাংলার জনগণের দাবীকে পাশ কাটিয়ে কাশ্মীর ইস্যুকেই বড় করে ধরেছিলেন। ঘােষিত পার্লামেন্ট নির্বাচনকে সামনে রেখে যেখানে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে কার্যকর ও অর্থবহ করার লক্ষ্যে তঁার উদ্যোগ ছিলাে অপরিহার্য, সেক্ষেত্রে মওলানা ভাসানী জিযার পরিকল্পিত প্রিন্ট অনুসারেই কাজ করেছেন মাত্র। জাতির জনক ও জাতীয় চার নেতার অবর্তমানে মওলানা ভাসানী জাতীয় নেতার গুরু দায়িত্ব পালনে সক্ষম হলেন না। এটা ছিলাে জাতীয় জীবনে দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা। ১৯৭৭ সনের ফেব্রুয়ারী মাসের অনুষ্ঠিতব্য পার্লামেন্ট নির্বাচন সম্পর্কে মওলানা ভাসানীর মন্তব্য। ছিলাে “দেশে অনুকূল পরিবেশ থাকলে নির্বাচন হবে। এটা ছিলাে প্রকৃত পক্ষে নির্বাচন বিরােধী চক্রের প্রতিধ্বনি মাত্র। জিয়াউর রহমানের নির্বাচন স্থগিত প্রক্রিয়ায় সাহায্যে মওলানা ভাসানী অন্য এক বিবৃতিতে বললেন “দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নির্বাচনী পরিবেশের উপযােগী নয়। বরং জনগণ এই মুহূর্তে নির্বাচন চায় না। জনগণ নির্বাচন চায় কি চায় না সে ব্যাপারে গণভােট অনুষ্ঠান নেয়া হােক। তাছাড়া অতীতেও জনগণ নির্বাচনের মাধ্যমে কোন প্রকার লাভবান হয়নি। জিয়াউর রহমানের চীন সফরের ব্যবস্থা ঠিকঠাক হয়ে গেলে মওলানা ভাসানী আরাে এক ধাপ এগিয়ে গিয়ে বলেন, “তিনি এই মুহূর্তে জাতিকে বিভক্ত করতে চান না, নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলেই জাতি বিভক্ত হয়ে যাবে। তাই আপাততঃ নির্বাচন স্থগিত রেখে সামরিক শাসন বজায় রাখা হােক।”৫. নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের জন্য প্রেসিডেন্ট সায়েম নির্বাচন কমিশনকে ভােটার লিস্ট তৈরি করার আদেশ প্রদান করেছিলেন। ভােটার লিস্ট তৈরীও হয়েছিলাে-যার ভিত্তিতে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনও অনুষ্ঠিত হয়েছিলাে। কিন্তু ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের গােপন রিপাের্টে জিয়ার নিকট পরিস্কার হয়ে গেলাে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীরাই শতকরা ৬০%টি আসন দখল করেছে। ঐ নির্বাচনে বামডান চীনপন্থী ও মুসলিম লীগের গণভক্তির বিচ্ছিন্নতা প্রমাণ হওয়ার পর জিয়াউর রহমানের নিকট ১৯৭৭ সনে ফেব্রুয়ারি মাসের নির্বাচন স্থগিত বা বাতিল করা ব্যতীত অন্য কোন বিকল্প রাস্তা খােলা ছিল না।৬ ৬. গণবিচ্ছিন্ন চৈনিকপন্থী দল, গােষ্ঠী ও ব্যক্তি মিলে জাতীয় প্রতিরােধ কমিটি গঠন করে এবং রুশ-ভারতের দালালদের নিশ্চিহ্ন করার লক্ষ্যে বিপ্লবী শ্লোগান তােলে। সামরিক শাসনের কড়া সেন্সরশীপের মধ্যেও আওয়ামী-বাকশালী ও “রুশ-ভারতের কথিত দালালদের বিরুদ্ধে উচ্চকণ্ঠ বৈপ্লবিক লড়াইয়ের ভাষা প্রচারিত হতে বাধা পায়নি। স্বাধীনতার বিরােধীতাকারী এসব চৈনিক’গ্রুপ আন্ডার গ্রাউন্ড রাজনৈতিক নেট ওয়ার্কের মাধ্যমে ৭৫ সনের ১৫ আগস্ট পূর্ববর্তী সময়ে সশস্ত্র বিপ্লবের কর্মসূচী গ্রহণ করে। সমগ্র দেশে খতমের রাজনীতি শুরু করে। ‘মুসলিম বাংলার' শ্লোগান তােলে। মুসলিম বাংলা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টোর নিকট অর্থ ও অস্ত্র সাহায্য প্রার্থনা করে।৭ জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর এসব চৈনিক পন্থী উল বিপ্লবীগণ প্রকাশ্য রাজনীতিতে আবির্ভূত হয়। এবং ঘােষিত ১৯৭৭ সনের ফেব্রুয়ারী মাসের নির্বাচনের বিরােধীতা করে। জেনারেল জিয়াউর রহমানের সঙ্গে বৈঠক ও আঁতাত করে নির্বাচন বানচালের জন্য জাতীয় প্রতিরােধ কমিটি’ নামে তথাকথিত কমিটি গঠন করে। জাতীয় প্রতিরােধ কমিটির শরীক দলগুলাে সর্বদা নির্বাচন বিরােধীতা করে এসেছে। আসলে তারা নির্বাচনেই বিশ্বাস করেন না। নির্বাচন এলেই তারা ভােটের বাক্সে লাথি মেরে ভাত দাবি করেন। এটাই তাদের রাজনীতি। জাতীয় প্রতিরােধ কমিটি’ রুশ-ভারত ও আওয়ামী বাকশালীদের প্রতিরােধ করতে গিয়ে প্রকারান্তরে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ও গণতন্ত্রকেই প্রতিরােধ করেছে। চীনপন্থী ও পাকিস্তান পন্থী গ্রুপ সামরিক সরকারের নেপথ্য শক্তিধর ব্যক্তি জিয়াউর রহামনের হাতের ক্রীড়নক হয়ে নির্বাচন বানচালের ষড়যন্ত্রমূলক খেলায় উঠেছিলাে। নির্বাচনকে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সামরিক শাসনের যাঁতাকলে নিষ্পেষিত জাতির জন্য, গণতন্ত্রে উত্তরণের প্রয়ােজনে নির্বাচন যে ক্ষেত্রে ছিল অপরিহার্য, সেক্ষেত্রে জিয়ার ছকে পা দিয়ে মার্শাল ল প্রলম্বিত করার ঘৃণ্য তৎপরতায় তােয়াহা সাহেব, ছিলেন চক্রান্তে লিপ্ত।৭. জনাব সায়েম বলেছেন, তার উপদেষ্টাগণ বিশেষ করে দেশে দ্রুত গণতান্ত্রিক পরিবেশ, দলগঠন নির্বাচন ও নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তরে জন্য রাষ্ট্রপতির বিশেষ সহকারী হিসেবে বিচারপতি আবদুস সাত্তার যাকে বিশ্বাস ও আস্থার সঙ্গে উপরােক্ত লক্ষ্য সাধনের জন্য নিয়ােগ দান করেছিলেন তিনিও ঐ চক্রান্তের অংশীদার হয়ে নির্বাচন পিছিয়ে দেবার পক্ষে ছিলেন। রাষ্ট্রপতি বলছিলেন, দেশে রাজনৈতিক শূন্যতা বিরাজ করছে। অন্যদিকে উপদেষ্টাদের মধ্যে অনেকেই তখন বলে চলেছিলেন দেশে রাজনৈতিক শূন্যতা নেই। অর্থাৎ রাজনীতি বন্ধ করার পর সামরিক শাসনের মধ্যেও কি করে রাজনৈতিক শূন্যতা থাকে না তা বােধগম্য হলেও এটা পরিষ্কার হয়ে আসছিলাে যে জিয়াউর রহমান সরকারী খরচে হেলিকপ্টার, যানবাহন, টিভি, রেডিও-ও প্রচার মাধ্যমে রাজনৈতিক নেতৃত্বের ভূমিকায় জোরেশােরেই অবতীর্ণ হয়েছিলেন। যদিও রাজনৈতিকভাবে নেতা কর্মীদের গ্রেফতার করা হচ্ছিল নির্বিচারে। ১৯৭৬ সনের ৮ই জানুয়ারি সামরিক ফরমান জারি করে বলা হয়েছিলাে, বক্তব্য, লেখনি, স্বাক্ষর বা প্রতীক দ্বারা যেভাবেই হােক না কেন সামরিক শাসন জারী, বলবৎ থাকা নিয়ে প্রধান সামরিক প্রশাসক বা ডেপুটি সামরিক প্রশাসক বা সামরিক কর্তৃপক্ষের কার্যক্রমের বিরুদ্ধে কথা বললে দশ বছর পর্যন্ত সাজা হতে পারে। [পরিশিষ্ট-৭] এই ফরমান জারির মূল লক্ষ্য ছিলাে, আওয়ামী লীগসহ স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি যেন মাঠে নামতে না পারে।৮. দেশ গণতন্ত্রের পথে স্বাভাকিভাবে অগ্রসর হােত জিয়াউর রহমানের নিকট ছিল তা অনাকাঙ্খিত। গণতন্ত্রের গতিরুদ্ধ করা হয়েছে বারবার। তথ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকা অবস্থায় ১৯৭৬ সনের ৩রা অক্টোবর জিয়াউর রহমান কড়া মার্শাল ল'-এর মধ্যে ভয়েস অব আমেরিকার প্রতিনিধি মিঃ ওয়েন কোরকে বাংলাদেশে নিয়ে আসেন। প্রচুর উপঢৌকন, খানাপিনা এবং হােটেল ইন্টারকনের আরামদায়ক কক্ষে অবস্থান করে তিনি ভােয়া থেকে প্রচারিত এক প্রতিবেদন উল্লেখ করেন যে, “বাংলাদেশের জনগণ এক্ষুণি নির্বাচন চায় না, নির্বাচনের প্রয়ােজন নেই। প্রতিবেদনে বলা হয় সামরিক শাসনে জনগণ ভালাে আছে, জনগণ হারাবার ঝুঁকি নিতে চায় না। ৯৯. বিচারপতি সায়েম একাকী হয়ে পড়েন। তার উপদেষ্টাগণও বঙ্গভবনে আসার চাইতে আর্মি হেডকোয়ার্টারে দৌড়ানােতে স্বাচ্ছন্দ্যরােধ করেন। আওয়ামী লীগ ব্যতীত চীন-পাকিস্তানপন্থী রাজনৈতিক দলগুলাের নেতৃবৃন্দ ক্যান্টনমেন্টের দিকে ছুটতে থাকেন। জিয়াউর রহমান দেখলেন নির্বাচন বন্ধ না করতে পারলে তার ক্ষমতার পথ চিরতরে রুদ্ধ হয়ে পড়বে। কালবিলম্ব না করে জিয়াউর রহমান ২৯শে নভেম্বর ৭৬ সনে প্রধান সামরিক পদটি বিচারপতি সায়েমের নিকট কেড়ে নেন। অসহায় বিচারপতির করুণ নিঃশব্দ আত্মনা তার বইয়ের বিবরণীতে প্রকাশিত হয়েছে। ১০দেশে মার্শাল ল জারি থাকার প্রেক্ষিতে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের পদটি কেড়ে নেওয়ার ফলে সায়েম ‘ফুটো জগন্নাথ’ হিসেবে কেবলমাত্র রাষ্ট্রপতির পদটিতে বহাল থাকলেন মাত্র।১০, বিচারপতি সায়েম জিয়াউর রহমানের উচ্চাভিলাষ এবং দেশকে গণতন্ত্রের পথে এগিয়ে নিয়ে যাবার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করার কারণে জেনারেল জিয়াকে। সরিয়ে সেনাবাহিনীর প্রধান হিসেবে নতুন কোন সামরিক ব্যক্তিত্বকে নিয়ােগ দানের কথা ভাবছিলেন। এয়ার ভাইস মার্শাল বাশারেরও এতে সম্মতি ছিলাে। বলাবাহুল্য, এয়ার ভাইস মার্শাল বাশার বিমানবন্দরে এক রহস্যময় বিমান দুর্ঘটনায় নিহত হন। মুক্তিযােদ্ধা মােহাম্মদ খাদেমুল বাশারের নিহত হওয়ার রহস্য। জিযার জীবদ্দশায় কেন, আজ পর্যন্ত জনসাধারণ জানতে পারেনি।১১. ১৯৭৬ সনেই জিয়ার রহমান এয়ার ভাইস মার্শাল এম জি তােয়াবকে সরিয়ে দেয়। কেননা সেনাবাহনিীর আর্টিলারী ফিল্ড রেজিমেন্ট ও ট্যাংক রেজিমেন্টসহ পদাতিক বাহিনীর উল্লেখযােগ্য অংশ তােয়াবকে সমর্থন করে যাচ্ছিলাে এবং তােয়াব ক্রমান্বয়ে তার অবস্থান দৃঢ় করতে প্রয়াস পাচ্ছিলাে। জিয়া অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে নির্মম নিষ্ঠুরতার সঙ্গে তার পথের কাটা সরিয়ে দিতে দ্বিধা করেনি।১১১২. এই অবস্থার মধ্যেও প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক বিচারপতি আবু সাদাত মােহাম্ম। সায়েম দেশে দ্রুত রাজনৈতিক প্রক্রিয়া শুরু করার লক্ষ্যে ১৯৭৬ সনের ১১ই আগস্ট সামরিক ফরমান জারি করে হাইকোর্ট বিভাগে সংক্ষুদ্ধ ব্যক্তিদের আইনে আশ্রয় লাভের অধিকারের গ্যারান্টি প্রদান করেন। সেই সুবাদে গ্রেফতারকৃত আওয়ামী লীগ নেতা বেগম সাজেদা চৌধুরী, সালাহউদ্দিন ইউসুফ, আবদুল মমিন তালুকদারসহ বিভিন্ন নেতৃবৃন্দের মুক্তির লক্ষ্যে হাইকোর্টে রীট পিটিশন দায়ের করা সম্ভব হয়েছিলাে। যা ইতিপূর্বে সামরিক ফরমান বলে নিষিদ্ধ ছিলাে।১৩. জিয়াউর রহমান জাতীয় প্রতিরােধ কমিটির নেতাদের দিয়ে নির্বাচন পিছানাের দাবি তুলে তাদের হাত থেকে নিজের হাতে বলটি তুলে নেন। ইতিপূর্বে নির্বাচন অনুষ্ঠান ঘােষণার মাধ্যমে যা ছিলাে জিয়াউর রহমানের হাতের নাগালের বাইরে। জিয়াউর রহমান তার দক্ষ গােয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে ভালাে করেই জানতেন প্রতিরােধ কমিটি নেতারা নির্বাচনে বিশ্বাস করে না। সেজন্য নির্বাচন পেছানাের দাবি তাদের দ্বারা সহজেই গেলানো সম্ভব। ১৯৭৭ সনের ফেব্রুয়ারী মাসের সাধারণ নির্বাচন স্থগিত ঘােষনার পর চৈনিকপন্থীদের ‘মগজ' নামে খ্যাত জনাব এনায়েত উল্লাহ খান এক সাক্ষাৎকারে বলেন, “জাতীয় প্রতিরােধ কমিটির আর প্রয়ােজন নাই।” “দেশে রাজনৈতিক শূন্যতা চলছে।” অপর এক প্রশ্নের উত্তরে জনাব এনায়েত উল্লাহ খান বলেন, বর্তমান সরকারকে কোন অবস্থাতেই অন্তবর্তীকালীন সরকার বলে উল্লেখ করা যায় না। কেননা, তারা এই মুহূর্তে ক্ষমতা হস্তান্তর করছেন না। তিনি বলেন, “আওয়ামী লীগ ও সিপিবি দেশের প্রধান শক্র। কেননা তারা ১৯৭৫ সনের ১৫ই আগষ্টের ঐতিহাসিক পরিবর্তনকে আজো মেনে নেয়নি। তিনি বলেন, সরকার জাতীয় কনভেনশন নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করছেন।১২১৪. জনাব আতাউর খানের জাতীয় লীগের পক্ষ হতে জাতীয় লীগের জনাব আবুল কাশেম নির্বাচন স্থগিত করার দাবি জানিয়ে এক বিবৃতি দেন। বিবৃতিটি সরকারী প্রচার মাধ্যমে ফলাও করে প্রচার করা হয়। ৭৭-এর ফেব্রুয়ারীতে যথাসময়ে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে জাতীয় ঐক্য ও সংহতি বিপন্ন হয়ে পড়বে'- এ মর্মে জাতীয় প্রতিরােধ কমিটিও অনুরূপ বিবৃতি প্রদান করে। জনাব আতাউর রহমান খান যথাসময়ে নির্বাচন প্রদানে দাবি এত বেশী করেছেন যে, এখন তিনি নিঃশ্রুপ। এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন-“প্রদত্ত বিবৃতিই তার পার্টির মতামত।” স্বাধীনতা বিরােধী চক্রের অন্যতম হােতা মওলানা মতিন আরও এক ধাপ এগিয়ে গিয়ে বলেন, ‘নির্বাচন দিলে তিনি ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাও করবেন।'১৩ জিয়াউর রহমান এসব রাজনীতিবিদদের কাজে লাগিয়ে কাগুজে পরিস্থিতি সৃষ্টিকরে ১৯৭৭ সনের ফেব্রুয়ারীর মধ্যে অনুষ্ঠিতর ও প্রতিশ্রুত পার্লামেন্ট নির্বাচন স্থগিত ঘােষণা করতে বিচারপতি সায়েমকে বাধ্য করলেন। প্রতিশ্রুত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার গতিরুদ্ধ হয়ে গেলাে।১৫. বিচারপতি সায়েম ১৯৭৫ ১৯৭৫ সনের ৬ই নভেম্বর ক্ষমতা গ্রহণের পর নির্বাচিত জাতীয় সংসদ ভেঙে দেন-যদিও এই জাতীয় সংসদের মেয়াদ ছিলাে আরাে ৪ বছর। সেই সময় তিনি প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সামরিক প্রশাসক হিসেবে জাতিকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন '৭৭ সনের ফেব্রুয়ারী মাসের মধ্যে পার্লামেন্ট নির্বাচন সম্পন্ন করবেন। প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের পদ থেকে বিচারপতি আবু সাদতমােঃ সায়েমকে অস্ত্রের মুখে তাড়িয়ে দিয়ে মেজর জেনারেল জিয়া প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের পদ ও ক্ষমতা দখল করে ঘােষণা দেন যে, প্রেসিডেন্ট, প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে এবং তার প্রতি জনগণের আস্থা আছে কিনা? অর্থাৎ মেজর জেনারেল জিয়া দেশে পার্লামেন্টারী গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পরিবর্তে প্রেসিডেন্টশিয়াল পদ্ধতি বহাল রাখার পক্ষে অগ্রসর হলেন।জিয়াউর রহমানের নির্বাচনী’ সার্কাস হাঁ/না ভােট শেষ হওয়ার পর পূর্ব প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী পার্লামেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা। কিন্তু জিয়াউর রহমান সে পথে অগ্রসর হলেন না। অত্যন্ত গােপনে তিনি প্রেসিডেন্ট পদ্ধতি বহাল ও প্রেসিডেন্ট নির্বাচন জন্য অগ্রসর হতে থাকেন।(এই ধারাবাহিক লেখাটি কিছুদিন বিজয় দিবস উপলক্ষে বন্ধ ছিলো। এখন থেকে আবার চলবে… )Reference: জেনারেল জিয়ার রাজত্ব -অধ্যাপক আবু সাইদভিডিও – খাদেমুল বাশারের রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন
Posted by সংগ্রামের নোটবুক on Saturday, January 11, 2020