১৩ এপ্রিল ১৯৭১ চারঘাট থানাপাড়া গণহত্যা দিবস।
১৯৭১ সালের ১৩ এপ্রিল পাক বাহিনী থানাপাড়া নামক গ্রামে এক নৃশংস হত্যালীলা চালিয়েছিল। সেদিন পাক সেনারা সারদা বাজার ক্রস করার সময় ওঁৎ পেতে থাকা মুক্তিযোদ্ধারা তাদের ওপর অতর্কিত হামলা চালায়। তবে তাদের ভারী অস্ত্রের কাছে মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটতে বাধ্য হয় । পাক সেনারা পুলিশ একাডেমি দখলে নেয়। খবর চারিদিকে ছড়িয়ে পরলে থানাপাড়া সহ আশেপাশের গ্রাম থেকে লোক একত্রিত হয় পদ্মার চরে। তাদের উদ্দেশ্য ছিল পদ্মা পাড় হয়ে ভারতে আশ্রয় নেওয়া। সঠিক সংখ্যা পাওয়া না গেলেও সেদিন প্রায় দুই হাজারের বেশি লোক চরে জমা হয়েছিল বলে জানা যায়। এই খবর পাক হায়েনার দলের কাছে গেরে তারা থানাপাড়ার চরের দিকে অগ্রসর হয়। চরে সেদিন বেশি নৌকা ছিল না। যা ছির সেটা দিয়ে সবার পারাপারের কোন উপায় ছিল না। অবশ্য কিছু মানুষ আগেই ভারতে গিয়ে আশ্রয় নিতে সক্ষম হয়েছিল। সামনে নদী আর পেছনে পাক সেনা। অবশেষে হায়েনার দল থানাপাড়া-কুঠিপাড়ার লোকদের পাকড়াও করে ফেলে। তারা সবাইকে সারি সারি করে দাড় করায়। প্রথমে এরা গুলি চালায় না। উপরস্থ কম্যান্ডের কাছে ওয়্যারলেসের মাধ্যমে খবর নেয়।উপরস্থ কম্যান্ডের নির্দেশ পেয়েই মহিলা আর বাচ্চাদের আলাদা রাখা হয়। পুরুষদের একে একে হত্যা করা হয়। যুবক বৃদ্ধ কেউ তাদের হাত থেকে রেহাই পায়নি। একজন বৃদ্ধ স্বেচ্ছায় শহীদ হন। তিনি বলেন-“ তুমরা সব মরি গেলে আমরা ব্যাঁচি থ্যাকপ কিসের ল্যাগি?” বৃদ্ধের নাম ছিল আব্দুর রহিম খলিফা। একে একে হত্যা করে তাদের লাশ স্তুপাকারে জমা করে আগুনে পুড়িয়ে ফেলা হয়। কিছু লাশ নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হয়। অযত্নে অবহেলায় অনেক লাশ পড়ে থাকে সেখানে। জীবিত লোকেরা গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে যায়। ফিরে আসে তিন দিন পর। ততদিনে লাশ সনাক্ত করা অসম্ভব ছিল। লাশের গন্ধ বাতাসে ভেসে বেড়িয়েছে প্রায় কয়েক সপ্তাহ ধরে। অনেক লাশের বিক্ষীপ্ত অঙ্গ-প্রতঙ্গ বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল। চিল-শকুন কুড়ে কুড়ে খেয়েছে এসব লাশের অঙ্গ-প্রতঙ্গ।
সেদিনের অনেক প্রত্যক্ষদর্শী আজও বেঁচে আছেন। সেদিনের কথা বলতে গিয়ে আজও তাদের গাযে কাঁটা দেয়। সেদিন সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে যান গাজীপুর কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ডীন ড. মোঃ জিন্নাতুল আলম। তিনি জানান, সেদিন সবার সাথে তাকেও হত্যার উদ্দেশ্যে লােইনে দাড় করানো হয়। তাঁকে দেখে শিক্ষিত মনে হলে পাক সেনারা তাঁকে এই ব্যাপারে প্রশ্ন করে। তিনি নিজেকে বিশ্ববিদ্যারয়ের ছাত্র হিসেবে পরিচয় দেন। তাঁর নাম জিন্নাহ শুনে থমকে যায় পাক সেনারা। পাকিস্তানের জাতির জনকের সাথে তাঁর নামের মিল থাকায় পাক সেনাদের মনে দয়া জাগে। তিনি তাদের উদ্দেশ্যে বলেন-“ দেখিয়ে, মুজকো মারিয়ে কোই আফসোস নেহি; লেকিন মেরে মাকো কন দেখেগা?” তারা তাকে পরীক্ষা-নিরিক্ষা করে ছেড়ে দেয়। সেদিন দলের সাথে থাকা মাহমুদা বেগম গিনি, যিনি এখন থানাপাড়া সোয়ালোজের সহকারী নির্বাহী প্রধান বলেন, বেলুচ সেনারা তুলনা মূলকভাবে ভাল ছিল। সেদিনের ঘটনা অনেক মানুষের স্বপ্ন কেড়ে নেয়। অনেক মহিলা এমনকি নব বধুকে বিধবা হতে হয়। অনেকেই গুলির চিহ্ন নিয়ে বেঁচে ছিল/আছে এখনো। এই নারকীয় হত্যাকাণ্ডের পর সবাই এই গ্রামকে “বিধবাদের গ্রাম” বলতে থাকে। এক সাথে এত বিধবা এই অঞ্চলে আর কোথাও দেখা যায়নি। উল্লেখ্য, পাক হায়েনাদের আক্রমণে সারা দেশে লক্ষ লক্ষ লোক মারা যায়। তবে এক সাথে, একি সময়ে এত গুলি লোক আর কোথাও শহীদ হয়নি। সেদিক থেকে থানাপড়ার গণহত্যার বিষয়টি আঞ্চলিক গণ্ডি পেরিয়ে জাতীয় পর্যয়ে মর্যাদা পাওয়ার দাবি রাখে। এই ঘটনার পর ১৯৭২ সালে অসহায় ও বিধবাদের কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে ‘থানাপাড়া সোয়ালোজ ডেভেলোপমেন্ট সোসাইটি’- নামের একটি এনজিও গঠিত হয়।(সংগৃহীত)