বাঙলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের সমর্থনে ভারতীয় মহিলা ফেডারেশনের প্রস্তাব
সূচীর পক্ষে তাঁদের বিপুল ভােট দানের মাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে। পূর্ব বাঙলায় আওয়ামী লীগ ৯৮ শতাংশ আসন জয় করে জাতীয় পরিষদে নিরঙ্কুশ সখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেন। পাকিস্তানের সামরিক স্বৈরশাসক, গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে জনসাধারণের এই রায়কে পদদলিত করলেন জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বসতে দিলেন না। এটা অত্যন্ত সাংঘাতিক ঘটনা যে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান যখন আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবর রহমানের সঙ্গে আলােচনা শুরু করলেন ঠিক তখনই তিনি পূর্ব বাঙলার নিরস্ত্র ও অপ্রস্তুত জনসাধারণের দিকে তার বন্দুক ঘুরিয়ে ধরলেন, শত সহস্র মানুষকে হত্যা করা হল, বাড়ি ঘর জ্বালিয়ে দেওয়া হল এবং মেয়েদের সম্রম নষ্ট করা হয়।
নির্বাচনের মাধ্যমে অর্জিত জনসাধারণের গণতান্ত্রিক অধিকারের এই নিদারুণ অস্বীকারই পূর্ব বাঙলার জনসাধারণকে তাদের স্বাধীনতা ঘােষণা করতে বাংলাদেশ সরকার গঠন করতে বাধ্য করেছে। কার্যকরী কমিটি বাঙলাদেশের মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকারের উপর এই আক্রমণের তীব্র নিন্দা করছে। বাঙলাদেশের জনতার উপর ইয়াহিয়া খানের সামরিক চক্রের পশুশক্তি নিদারুণ অত্যাচারের নিন্দা করে যে বাক্যই প্রয়ােগ করা হােক, তা যথেষ্ট কঠোর নয়।
পাকিস্তানের সামরিক চক্রকে সেন্টো ওসিয়াটোর মাধ্যমে পশ্চিমী সাম্রাজ্যবাদীরা এতদিন যাবৎ যে অস্ত্র-শস্ত্র সাহায্য দিয়ে এসেছে কার্যকরী কমিটি তার তীব্র নিন্দা করছে। এই অস্ত্র-শস্ত্রের সাহায্যেই পাক সামরিক চক্র পূর্ববাঙলা নিরাপরাধ মানুষ এমন কি অগণিত নারী ও শিশুকে হত্যা করছে। ইয়াহিয়ার পূর্ববাঙলায় এই গণ-হত্যাকাণ্ডকে সমর্থনের জন্য চীনের সরকারেরও নিন্দা করা হয়েছে।
বাঙলাদেশের গণতান্ত্রিক জনতার উপর এই বর্বর আক্রমণের নিন্দা করার জন্য এবং বাঙলাদেশের জনসাধারণের সমর্থনে এগিয়ে আসার জন্য কার্যকরী কমিটি দুনিয়ার সকল দেশের গণতান্ত্রিক জনতাকে আহ্বান জানিয়েছে।
কমিটি এবং মুহূর্তে বাঙলাদেশে এই গণহত্যা বন্ধ করে পশ্চিম পাকিস্তানী সশস্ত্র বাহিনীকে প্রত্যাহার করে নেওয়ার এবং শেখ মুজিবর রহমানসহ মুক্তিযুদ্ধের যে সৈনিকরা পাকিস্তানের করান্তরালে বা বন্দী শিবিরে আটক রয়েছেন তাদের মুক্তি দাবি জানিয়েছেন। পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকচক্রের হস্তক্ষেপ বন্ধ হলে বাঙলাদেশের মানুষ তাদের নিজেদের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করতে পারবেন।
বাঙলাদেশের সরকারকে স্বীকৃতি দিয়ে মুক্তিযােদ্ধাদের সম্ভাব্য সমস্ত সাহায্য দেওয়ার জন্য কমিটি ভারত সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছে।
পূর্ববাঙলায় মানুষের গণতান্ত্রিক ও মানবিক অধিকারকে এইভাবে দলিত করার ভয়াবহ ফলাফল সম্বন্ধে অবহিত হওয়ার জন্য কার্যকরী কমিটি জাতিসংঘ ও অন্যান্য গণতান্ত্রিক বিশ্ব সংস্থাগুলি বিশেষ করে বিশ্বের সমস্ত মহিলা সংগঠনগুলির প্রতি প্রস্তাবে আহ্বান জানান হয়েছে। এবং আন্তর্জাতিক বিষয়ের নামে এই অমানুষিক কার্যকলাপ চলতে দিলে জাতিসংঘ মানবতা ও গণতান্ত্রিক অধিকারের নামে যে শপথ বাক্য এতদিন শুনিয়ে এসেছেন সে সবই শূন্যগর্ভ ও নিরর্থক হয়ে দাঁড়াবে এবং জাতিসংঘের অস্তিত্বই বিপন্ন হবে বলে প্রস্তাবে ক্ষোভ প্রকাশ করা হয়েছে।
ইয়াহিয়ার সেনা বাহিনীর অত্যাচারে বাঙলাদেশের লক্ষ লক্ষ মানুষ ভারতে শরণার্থী হয়ে এসেছেন আমাদের যত অসুবিধাই হােক না কেন এই শরণার্থীদের সম্পূর্ণ সমর্থন ও সাহায্য দেওয়ার জন্য আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে যাতে তারা নিজেদের দেশকে মুক্ত করে সেখানে ফিরে যেতে প্রস্তাবে ভারতের সকল রাজ্যের মহিলা সাধারণের কাছে সমস্ত রকম সংকীর্ণ প্রাদেশিকতা ও সাম্প্রদায়িকতা দূর করে একটি সুদৃঢ় ও ঐক্যবদ্ধ জাতি হিসাবে সমগ্র দেশকে প্রস্তুত করে ভােলার জন্য তাদের প্রভাব বিস্তার করার আহ্বান জানান হয়েছে। বাঙলাদেশে ইয়াহিয়া খানের সামরিক এক নায়কতন্ত্রের পশু শক্তির বিরুদ্ধে আমাদের যে ভাইবােনেরা বীরের মত সংগ্রাম করছেন তাদের সমর্থনে এই দৃঢ়-ঐক্যবদ্ধ ভারত এগিয়ে আসবে।
কার্যকরী কমিটি এই সুযােগে বাঙলাদেশে অসংখ্য নারী ও বিশেষ করে তরুণীসহ যে অগণিত শহীদ স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম করে প্রাণ দিয়েছেন তাদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন এবং বাঙলাদেশের মহান মুক্তি যােদ্ধাদের অভিনন্দন জানিয়ে তাদের ন্যায় যুদ্ধে ভারতের নারী সমাজের সমর্থন এবং অবিরাম সাহায্য ও সহযােগিতার আশ্বাস দিয়েছেন।
সূত্র: কালান্তর, ১৫.৬.১৯৭১