সৈয়দ আব্দুস সামাদ (সিএসপি ১৯৬৫)
এর সম্পর্কে এইচ, টি. ইমাম লিখেছেন: “আমি রাঙামাটিতে ফিরে আমার অফিসের সকল কর্মকর্তা-কর্মচারীকে ডেকে নিলাম। আমার সহকর্মীদের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযােগ্য ভূমিকা ছিল সৈয়দ আবদুস সামাদের। তিনি ছিলেন অ্যাডিশনাল ডেপুটি কমিশনার এবং পুনর্বাসন অফিসার। ঐ সময় টগবগে তরুন। প্রখর বাঙালি জাতীয়তাবাদী এবং স্পষ্টভাষী।”৩৪ অন্যত্র লিখেছেন, “এস. এ. সামাদ এবং এম. ই. শরিফ৩৫ রাঙামাটিতে আমাদের সাথে আলােচনার সাথে সাথে বের হয়ে পড়েন সমগ্র পার্বত্য এলাকায় ই.পি.আর ও পুলিশবাহিনীকে মানসিক প্রস্তুতি ও সংগঠিত করতে। তাদের দায়িত্ব ছিল জেলার বিভিন্ন থানা, বড় বড় হাট-বাজার ও পুলিশক্যাম্পে জওয়ানদের সাথে কথা বলা ও তাদেরকে আসন্ন স্বাধীনতাযুদ্ধের জন্য অনুপ্রাণিত করা। আরও কঠিন ও গুরুদায়িত্ব ছিল সীমান্ত এলাকার সকল ই.পি.আর. বর্ডার আউটপােস্টে (BOP) গিয়ে বাঙালি অফিসারদের সাথে কথা বলা ও গােপন ইঙ্গিত দিয়ে আসা।../ পাকিস্তানি মার্শাল ল তখনও পুরােপুরি বহাল। কী সাংঘাতিক ও ঝুঁকিপূর্ণ কাজ ছিল সামাদ আর শরিফের। তারপর ঐ রকম দুর্গম এলাকা-বন-জঙ্গল, পাহাড় আর বন্যপশু চারদিকে। সামাদ আর শরিফের চমৎকার সচলতা এবং যােজনার (mobilization) ফল আমরা ২৫/২৬ মার্চে হাতে-হাতে পাই। কঠোর পরিশ্রম আর উদ্যমের সাথে তরুণ সামাদ আর প্রৌঢ় শরিফ সমগ্র পার্বত্য-অঞ্চল চষে বেড়িয়েছেন। অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক তরুণ সামাদকেই নেতৃত্ব দিতে হয়েছে। প্রথমে কাপ্তাই, চন্দ্রঘােনা তারপর একে একে মারিশ্যা, জালিয়ানপাড়া, মহালছড়ি, মানিকছড়ি, মাসালং, দিঘিনালা, খাগড়াছড়ি, বরকল ইত্যাদি জায়গা থেকে সিগন্যাল এল সামাদের : আমরা সফল, সকলে প্রস্তুত। এখন চূড়ান্ত আহ্বানের অপেক্ষা। ২৫ মার্চ রাতে ক্যাপ্টেন হারুনের সাফল্য ও তারপর একে একে যেভাবে সবগুলাে বি.ও.পি. থেকে ই.পি.আর, জওয়ানেরা রাঙামাটিতে সমবেত হলেন তা পূর্বপ্রস্তুতি ছাড়া কিছুতেই সম্ভব ছিল না।”৩৬
নিজের মুক্তিযুদ্ধে যােগদানসম্পর্কে স্বয়ং সৈয়দ আব্দুস সামাদ তার স্থানীয় ঊর্ধ্বতন ‘বস’ (পার্বত্য চট্টগ্রামের তৎকালীন জেলা প্রশাসক) হােসেন তওফিক ইমামের নেতৃত্বে ও নির্দেশনায় রাঙামাটি জেলা সদর) এবং সন্নিহিত এলাকা যেমন বরকল, রামগড়, কাপ্তাই, চন্দ্রঘােনা ইত্যাদিকে কেন্দ্র করে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গঠন, বাঙালি সেনা কর্মকর্তা ও সেইসঙ্গে সীমান্তবর্তী ভারতীয় জেলাগুলাের কর্মকর্তাদের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ সংঘটনসম্পর্কিত যােগাযোেগ, তাদের সহায়তা কামনা ইত্যাদি এবং এরই ধারাবাহিকতায় পরে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ সীমান্ত পেরিয়ে আসাম বা অসমের শিলচর- শিলং হয়ে নানা পথ পাড়ি দিয়ে শেষে ‘গােহাটি থেকে ভারতীয় সেনাবাহিনীর অত্যন্ত পুরােনাে, রংচটা, ঝরঝরে ড্যাকোটা বিমানে দমদম’ হয়ে ‘কেনিলওয়ার্থ হােটেল ৮নং থিয়েটার রােডের ( মুজিবনগর হেড অফিস) ঠিক উল্টো দিকে’ তথা মুজিবনগর সরকারে যােগদান সম্পর্কে স্বপ্রণীত যখন দুঃসময়, সুসময় গ্রন্থে বিচ্ছিন্নভাবে বেশ দীর্ঘ বর্ণনা লিপিবদ্ধ করেছেন।
যেমন, “আমি তড়িঘড়ি একটা ট্যাক্সি নিয়ে সেখানে উপস্থিত হলাম বেলা ১০টার দিকে। ইমাম আর মােহাম্মদ নুরুল কাদের (ঝিলু) তখন ডাইনিং হলে প্রাতরাশ বা ব্রেকফাস্ট খাওয়ায় ব্যস্ত। আমি নিঃশব্দে গিয়ে তাদের টেবিলে যােগ দিলাম। তারা যেন অশরীরি(ী) কোনাে বস্তু বা ভূত দেখেছেন এমনভাবে চমকে উঠলেন পরম আশ্চর্যে। ইমাম উঠে এসে আমাকে উষ্ণ আলিঙ্গনে জড়ালেন, ঝিলুভাইও। আমরা তিনজনই তখন কাঁদছিলাম-সুখে, দুঃখে, বিস্ময়ে /.. নুরুল কাদের বিশাল দাড়ি রেখেছেন। দেখতে অনেকটা ফিডেল ক্যাস্ট্রোর মতাে লাগছিলাে। নির্ভেজাল, অবিমিশ্র বিপ্লবী, যেমনটি কিংবদন্তিতে পড়া বা শােনা যায়। হােটেলের বয়, বেয়ারা সকলে তার দিকে বারবার তাকাচ্ছিলাে। প্রাতরাশ সেরে আমরা ইমামের কামরায় গেলাম। অনেক কাগজপত্র। কিন্তু ইমামের স্বভাবসুলভ শৃঙ্খলাবােধ এখানেও দৃশ্যমান। তিনি কিছু কাগজ নিয়ে আলােচনা শুরু করলেন।”৩৭
লক্ষণীয়, মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ বা মুজিবনগর সরকারে যােগদান করার পর এখানে কারাে হাতেই এতটুকু সময় ছিল না নষ্ট করবার বা বৃথা অপচয়ের, যে- কারণে আমরা দেখতে পাচ্ছি, সৈয়দ আব্দুস সামাদের যােগদানের প্রথম দিন থেকেই সেখানকার নেতৃস্থানীয় কর্মকর্তা জনাব হােসেন তওফিক ইমাম তাকে নিয়ে কাজের কথায় ব্যস্ত বা জড়িতে হয়ে পড়েছিলেন। বস্তুত এটাই ছিল মুক্তিযুদ্ধের অবিস্মরণীয় দিনগুলােতে প্রায় প্রতিটি সংগ্রামী বাঙালির কর্মকৃতি।
Reference: মুক্তিযুদ্ধে সিএসপি ও ইপিসিএস অফিসারদের ভূমিকা