হানাদারমুক্ত বাংলাদেশে সরকার
বাংলাদেশের বীর মুক্তিযােদ্ধা এবং ভারতীয় বাহিনীর সমন্বয়ে গঠিত যৌথ কমান্ডের কাছে পাকিস্তান বাহিনীর শােচনীয় পরাজয় এবং গ্লানিকর আত্মসমর্পণের পর হানাদারমুক্ত বাংলাদেশে সরকারের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে স্বাধীন বাংলা বেতার এবং টেলিগ্রাম মারফত আমি (ক্যাবিনেট সচিব) প্রধানমন্ত্রীর মৌখিক অনুমােদনক্রমে সরাসরি বিভিন্ন নির্দেশ দিতে থাকি। স্বাধীন বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় সরকারের উচ্চপর্যায়ের এক অগ্রবর্তী দল প্রেরণের উদ্দেশ্যে ১৯৭১ সালের ১৮ ডিসেম্বর ৪৮৯(৮)/ক্যাব সংখ্যক অগ্রাধিকার (priority) লেখা স্মারক জারি করি (পরিশিষ্ট-৪)। স্মারকে মােট ৮ জন উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাকে কোলকাতার দমদম বিমানবন্দরে ভারতীয় সময় সকাল ৭-০০টায় অথবা ৮ নং থিয়েটার রােডে সকাল ৬-১৫ মিনিটে রিপাের্ট করতে অনুরােধ করা হয়েছিল। নিম্নলিখিত কর্মকর্তাবৃন্দের নাম ওই স্মারকে উল্লেখ করা হয় :
১. মুখ্যসচিব : জনাব রুহুল কুদ্স
২. রাষ্ট্রপতির উপদেষ্টা : জনাব এ, এফ, এম, এ, ফতেহ
৩. সংস্থাপন সচিব : জনাব এম, নূরুল কাদের
৪. পুলিশের মহাপরিচালক : জনাব এ খালেক
৫. সচিব, তথ্য ও বেতার : জনাব আনােয়ারুল হক খান
৬. সচিব, অর্থ : জনাব কে, এ. জামান।
৭. বেসামরিক বিমান চলাচল পরিচালক : উইং কমান্ডার মির্জা
৮, বন্দর, জাহাজ ও অভ্যন্তরীণ জলপথ পরিচালক : জনাব কিউ. এ. বি. এম. রহমান জনাব রুহুল কুদুসের নেতৃত্বে অগ্রবর্তী দল ঢাকায় পৌছেই বােমাবর্ষণে বিধ্বস্ত পাকিস্তানি আমলের গভর্নমেন্ট হাউস এবং স্টেট গেস্ট হাউস পরিদর্শনে গিয়ে এক ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। অগ্রবর্তী দলের আসাদুজ্জামান ও নূরুল কাদের এই ভবন দুটির নতুন নাম যথাক্রমে ‘বঙ্গভবন’ ও ‘গণভবন’ রাখার প্রস্তাব করেছিলেন। আজো (২০১৩ সালেও) নাম দুটি অক্ষুন্ন আছে। গভর্নমেন্ট হাউসকে দেওয়া নাম ‘বঙ্গভবন’ সেই ভবনই বহন করে যাচ্ছে। বঙ্গভবন নামটি বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতীক। আর গণভবন নামাঙ্কিত স্টেট গেস্ট হাউস থেকে পরর্তীতে শেরেবাংলা নগরে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন স্থানান্তর করলে তার নামকরণ করা হয় গণভবন। স্বাধীনতার পর শত্রুমুক্ত বাংলাদেশে প্রস্তাবিত নাম গণভবন অটুট আছে। ১৯৭৫ সালে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত দেশি-বিদেশি শক্তিগুলাে পরিকল্পিত উপায়ে সােনার বাংলার রূপরেখায় ব্যাপক পরিবর্তন আনলেও বঙ্গভবন এবং গণভবন নাম দুটি মুছতে পারেনি বাঙালি জাতির রােষানলের ভয়ে। ‘বঙ্গভবন’ ও ‘গণভবন’ দুটি নাম সৌভাগ্যবশত এখনাে অক্ষুন্ন আছে।
সময় দ্রুত গড়িয়ে যেতে থাকে। বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী কার্যালয়ের যাবতীয় নথিপত্রসহ কর্মকর্তা-কর্মচারীকে ঢাকায় প্রেরণের নিমিত্ত হাতে লিখেও নির্দেশ দেওয়া হয়। এদিকে বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী কার্যালয়েও জরুরি কাজকর্ম চালাতে হচ্ছিল। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণের পর বাংলাদেশ সরকারের প্রথম ও প্রধান কাজই ছিল বাংলাদেশের সর্বত্র শান্তি-শৃঙ্খলা ও স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা। বেসামরিক প্রশাসনব্যবস্থা সুপ্রতিষ্ঠা করাও ছিল সরকারের প্রধান কাজগুলাের মধ্যে অন্যতম। এ জন্য সময়ের প্রয়ােজন থাকলেও তা পাওয়া মােটেই সহজ ছিল না। বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকাসহ বন্দরনগরী চট্টগ্রাম, বিভাগীয় শহরগুলাে এবং গুরুত্বপূর্ণ। স্থাপনাগুলােকে প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেওয়াও সরকারের দায়িত্ব হয়ে পড়ে। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ঢাকার সচিবালয় এবং দেশের বিভিন্ন দপ্তরে বেসামরিক প্রশাসন প্রতিষ্ঠা করে স্বাধীন, সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা হয়। এসব কাজ সম্পন্ন করার সাথে সাথে অন্যান্য জরুরি কাজও সারতে হয়। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির নির্দেশে মন্ত্রিসভার এক বিশেষ জরুরি সভা ১৮ ডিসেম্বর আহ্বান করা হয়েছিল। সেই সভায় যেসব আলােচ্য বিষয় ছিল তার সবই ছিল প্রস্তুতিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্দেশ্যে । প্রথম বাংলাদেশ। সরকারের দূরদৃষ্টি, অভিজ্ঞতা, নৈপুণ্য ইত্যাদি সভার আলােচ্যসূচিতে ফুটে উঠেছিল। নিচে আলােচ্যসূচি বর্ণিত হলাে :
১. সামরিক ও পুলিশ বাহিনীর জন্য পােশাক
২. গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের নামে অ্যাকাউন্ট
৩. গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রশাসনিক কাঠামাে
৪. কৃষি মন্ত্রণালয়ের বাজেট
৫. ঢাকা বেতার কেন্দ্র নতুনভাবে চালুকরণ।
৬. গণবাহিনীর সদস্যদের প্রস্তাবিত জাতীয় মিলিশিয়ায় অন্তর্ভুক্তি
৭. সরকারি কর্মচারীদের পুনর্বিন্যাস। বিজয় দিবসের পর ১৯ ডিসেম্বর বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী কার্যালয় থেকে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের বরাবরে প্রেরিত ৪৯৫/ক্যাব সংখ্যক স্মারক (পরিশিষ্ট-৫) মারফত নিম্নলিখিত ৪ জন তথ্য ও বেতার সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের ঢাকায় প্রেরণ করার ব্যবস্থা হয়েছিল।
১, এ, জে, খান : পরিচালক ২. আসিফ আলী : প্রযােজক ও ক্যামেরাম্যান ৩. আলম : যুদ্ধক্ষেত্রের ফটোগ্রাফার ৪. ফেরদৌস : সহকারী ক্যামেরাম্যান এরা ছাড়াও আরাে একটি বড় দলকে ঢাকায় পাঠানাের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। এই অধ্যায়ের প্রথমে এই দলে অন্তর্ভুক্ত ব্যক্তিবৃন্দের নাম পদবিসহ উল্লেখ করা হয়েছে। ঢাকায় ফিরে আসার পূর্বমুহূর্তে বাংলাদেশ সরকার অসাধারণ দ্রুততার সাথে প্রয়ােজনীয় সিদ্ধান্ত নিয়ে কাজ করেছিল। এর মধ্যে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে অন্তত ১৫ দিনের অতি প্রয়ােজনীয় সামগ্রীর একটি তালিকা প্রণয়ন করা হয়েছিল। এই তালিকা ভারতীয় বৈদেশিক বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব মি, এ. কে. রায়ের কাছে প্রয়ােজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য প্রেরিত হয়। (পরিশিষ্ট-৬) মুজিবনগর থেকে বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী সদর দফতর স্থায়ী রাজধানী ঢাকায় স্থানান্তরের উদ্যোগ নেওয়া হলেও বাংলাদেশের সড়ক যােগাযােগব্যবস্থা অত্যন্ত নাজুক অবস্থায় থাকায় স্থানান্তর কাজ করা সহজ ছিল না। এ পরিস্থিতি মােকাবিলায় বন্ধুরাষ্ট্র ভারতের সামরিক বিমান পরিবহনের সহায়তা বাংলাদেশকে নিতে হয়। বাংলাদেশ সরকারের নবসৃষ্ট ছােট বিমান বাহিনীর বিমান পরিবহন কাজে যথেষ্ট উল্লেখযােগ্য ভূমিকা পালন করে। ঢাকায় কর্মস্থল স্থানান্তর এবং একই সঙ্গে অস্থায়ী কর্মস্থলে মন্ত্রিপরিষদের সব কাজকর্ম চালিয়ে অবশেষে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ ও অন্যান্য মন্ত্রী ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসের ২২ তারিখে একত্রে ঢাকায় ফিরে আসেন। বাংলাদেশ সরকারের সব নথি ও দলিল-দস্তাবেজ তাৎক্ষণিকভাবে সঙ্গে করে আনা সম্ভব না হওয়ায় কয়েকজন কর্মকর্তার হেফাজতে অবশিষ্ট নথিপত্র অস্থায়ী কার্যালয়ে রেখে আসতে হয়েছিল। অফিস-সরঞ্জাম গুছিয়ে নিয়ে আসার দায়িত্বও তাদের দেওয়া হয়। যথাসময়ে সেসব ঢাকায় আনা হয়েছিল।
ঢাকা প্রত্যাবর্তনের পর নেতৃবৃন্দের প্রথম কাজ ছিল বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তান থেকে মুক্ত করে আনা। এই লক্ষ্যেই সর্বশক্তি নিয়ােগ করা হয়েছিল। ভারত এবং অন্যান্য বন্ধুরাষ্ট্রের। মাধ্যমে এবং জাতিসংঘের মধ্যস্থতায়, বিশেষ করে মহাসচিব উ থান্টের ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় বঙ্গবন্ধুর মুক্তি এবং স্বদেশ প্রত্যাবর্তন সম্ভব হয়। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ঢাকায় ফিরেই বারবার ছুটে গিয়েছিলেন উদ্বেগাকুল বেগম মুজিব, ছেলেমেয়ে এবং বঙ্গবন্ধুর পিতামাতার কাছে। মুক্ত বাংলাদেশে ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ও অন্যান্য মন্ত্রিবর্গ ডিসেম্বর মাসের ২২ তারিখে একত্রে ঢাকা ফিরে আসেন। তখন ঢাকা শহর উৎসবমুখর। অন্যান্য সহকর্মীসহ আমরা যারা অস্থায়ী কার্যালয়ে অবস্থান করছিলাম, তাদের বেশির ভাগই ঐদিন ঢাকায় আসি। কয়েকজন কর্মকর্তাকে মুক্তিযুদ্ধকালীন অস্থায়ী রাজধানীতে রেখে আসা হয় নথিপত্র এবং অফিস-সরঞ্জাম গুটিয়ে নিয়ে আসার জন্য।
উল্লেখ করা প্রয়ােজন যে, মুক্তিযুদ্ধের শেষলগ্নে ১৬ ডিসেম্বর সকালে আমরা অস্থায়ী কার্যালয়ে সংবাদ পাই ওইদিনই বিকেলে পাকিস্তান সেনাবাহিনী আত্মসমর্পণ করবে। এ সংবাদের পরিপ্রেক্ষিতে মন্ত্রিসভা ১৬ তারিখ সকালেই জরুরি সিদ্ধান্ত নেয় যে, গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ. কে. খন্দকার বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করবেন আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে। অনেক চেষ্টা করেও কর্নেল এম.এ.জি. ওসমানীর সাথে যােগযােগ স্থাপন করতে না পেরে ওই সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছিল। আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানের পর ১৮ ডিসেম্বর থেকে কয়েকটি অগ্রবর্তী দলকে ঢাকায় পাঠানাে হয়েছিল। আমরা কয়েকজন কর্মকর্তা তখন রাজধানী ঢাকায় নতুন করে সরকারি কাজকর্ম চালু করতে ব্যস্ত। বেশির ভাগ সহকর্মী, যাদের আনুগত্য সম্পর্কে কোনাে সংশয় ছিল না।
তাদেরকে কালবিলম্ব না করে প্রশাসনের বিভিন্ন পদে নিয়ােগ করা হয়। পাকিস্তান সেনাবাহিনী যে সমস্ত বাঙালি অফিসারকে শেরেবাংলা নগরস্থিত তথাকথিত বন্দিশিবিরে (POV camp) আটক করে রেখেছিল, তাদেরকে মুক্ত করে যথাযথ সম্মানের সাথে সরকারি বিভিন্ন পদে নিয়ােগ দেয়া হয়। এদের মধ্যে ছিলেন আইয়ুবুর রহমান (সি.এস.পি, ১৯৫৯), আ. ন. ম. ইউসুফ (সি.এস.পি. ১৯৬১), সৈয়দ রেজাউল হায়াত (সি.এস.পি. ১৯৬৭), নূরুল মােমেন খান (পি.এস.পি, ১৯৬১), লােকমান হােসেন (ডিরেক্টর, ডাক ও তার বিভাগ), শাহ মােহাম্মদ ফরিদ (সি.এস.পি. ১৯৬৮) এবং আরাে অনেকে। এঁদের যােগদানের ফলে সরকারি কর্মকাণ্ডে গতি সঞ্চারিত হয়।
বিজয়ের প্রাক্কালে যেসব জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার ও অন্যান্য কর্মকর্তা নিয়ােগ করা হয়েছিল তারা বিপুল উৎসাহের সাথে প্রশাসনকে সচল করার দায়িত্ব পালন করতে থাকেন। ফলে কোনােখানে প্রশাসনিক শূন্যতা দেখা দেয়নি। ১৯৭১ সালের ২৩ ডিসেম্বর বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় প্রথম মন্ত্রিসভা বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় সাবেক পূর্বপাকিস্তান সরকারের ক্যাবিনেট রুমে। শেখ আবদুল আজিজ, ফণীভূষণ মজুমদার, আবদুস সামাদ আজাদ এবং জহুর আহমেদ চৌধুরীকে ২৭ ডিসেম্বর মন্ত্রিসভা সম্প্রসারণ করে মন্ত্রী নিয়ােগ করা হয়। পরদিন অধ্যাপক ইউসুফ আলীকেও মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। খােন্দকার মােশতাক আহমদকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে নিয়ে আবদুস সামাদ আজাদকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিয়ােগ করা হয়। মন্ত্রিসভার দ্বিতীয় বৈঠকটি হয় বঙ্গভবনের ক্যাবিনেট রুমে। এই প্রসঙ্গে দুটো সুদূরপ্রসারী এবং ঐতিহাসিক সিদ্ধান্তের কথা উল্লেখ করা প্রয়ােজন। এর প্রথম সিদ্ধান্ত ছিল গভর্নমেন্ট হাউস এবং স্টেট গেস্ট হাউস- ভবনের নামকরণ সংক্রান্ত। জনাব রুহুল কুদুসের নেতৃত্বে সরকারের অগ্রবর্তী দলটি ১৮ ডিসেম্বর তারিখে ঢাকায় পৌছে বােমাবর্ষণে বিধ্বস্ত গভর্নমেন্ট হাউসকে তাৎক্ষণিকভাবে নতুন নাম দেয় ‘বঙ্গভবন’। ‘বঙ্গভবন’ এজন্য যে, সেটি রাষ্ট্রের প্রতীক। অপর ভবনটি ছিল স্টেট গেস্ট হাউস মিন্টো রােড ও হেয়ার রােডের সংযােগস্থলে অবস্থিত। এই ভবনকে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে রূপান্তরের প্রস্তাব করা হয়। যেহেতু প্রধানমন্ত্রী জনগণের প্রতিনিধি এবং তার বাসভবন জনগণের জন্য উন্মুক্ত থাকবে, তাই এর নামকরণের প্রস্তাব করা হয় ‘গণভবন’। উল্লেখ করা প্রয়ােজন, যে-ভবনটির নাম গণভবন রাখা হয়েছিল পরে কোনাে এক সময়ে এর নাম ‘সুগন্ধা রাখা হয়। বর্তমানে সেই ভবনটি ফরেন সার্ভিস ট্রেনিং একাডেমি নামে অভিহিত হচ্ছে। দ্বিতীয় ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত ছিল রাষ্ট্রীয় কাজে বাংলার প্রচলন।
ঢাকায় ২৩ ডিসেম্বর সন্ধ্যা ৬টায় মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ প্রস্তাব করলেন যে আমাদের কার্যবিবরণী এবং সিদ্ধান্ত বাংলায় লেখা হােক। আমার পরম সৌভাগ্য যে এই ঐতিহাসিক কাজটি করার দায়িত্ব সে দিন পালন করতে পেরেছিলাম। নবসৃষ্ট বাংলাদেশ ব্যাংক এবং আরাে কয়েকটি বিষয়ে সরকারি প্রজ্ঞাপন জারি করা প্রয়ােজন ছিল। সে-সময় গেজেট বিজ্ঞপ্তিসহ সব কিছুই ছিল ইংরেজিতে। ওই দিনের বৈঠকে উল্লেখযােগ্য সিদ্ধান্তের মধ্যে ছিল-মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী মুক্তিবাহিনীর সদস্যদের জাতীয় মিলিশিয়া বাহিনীতে আত্তীকরণ এবং তাদের বেতন-ভাতা ও অন্যান্য সুবিধাদিরনীতিমালা প্রণয়ন, মুক্তিযােদ্ধাদের জাতীয় মিলিশিয়ায় অন্তর্ভুক্তিকরণ-সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে ১১-সদস্যবিশিষ্ট “জাতীয় মিলিশিয়া বাের্ড” গঠন, অর্থ মন্ত্রণালয় কর্তৃক দেশের রাজস্ব আদায় সম্পর্কিত ব্যবস্থাদির প্রস্তাব, সব করপােরেশন, সরকারি সংস্থা যাদের নামের সঙ্গে পাকিস্তান বা পূর্ব পাকিস্তান রয়েছে সেগুলােতে অবিলম্বে বাংলাদেশ নামটি প্রতিস্থাপন, স্টেট ব্যাংককে ‘বাংলাদেশ ব্যাংক’ নামে অভিহিতকরণ, মুক্তিযুদ্ধে শহীদের স্মরণে ঢাকায় স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ, যুদ্ধে শহীদ পরিবারের সদস্যদের সহযােগিতা ও সহায়তার জন্য স্মৃতি ট্রাস্ট তহবিল গঠন, শহীদ মিনার পুনর্নির্মাণ, ব্যুরাে অব ন্যাশনাল রিকনস্ট্রাকশন যা পাকিস্তান অ্যাফেয়ারস অ্যান্ড দি পাকিস্তান কাউন্সিল নামে পরিচিত তা অবলুপ্তিকরণ, শিল্পকলা এবং সাহিত্যের জন্য একটি জাতীয় কাউন্সিল গঠন, প্রেস ট্রাস্ট অবলুপ্তিকরণ, ২৫ মার্চের পর যেসব পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়েছে সেসব বাতিলকরণ এবং সংক্ষিপ্ত ও পরিবর্তিত সিলেবাসের ভিত্তিতে পুনঃপরীক্ষা অনুষ্ঠান, সকল পাটকল রাষ্ট্রায়ত্তকরণ ইত্যাদি। সরকারের আগ্রহে আর বিজি প্রেসের দক্ষতায় স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে রাষ্ট্রভাষা বাংলায় প্রজ্ঞাপন লেখা শুরু হয়। মন্ত্রিপরিষদের জন্য সারসংক্ষেপ, আলােচনা এবং মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্ত সবই বাংলায় আরম্ভ হয়ে যায়। বাংলা সাঁটলিপিকার খােন্দকার আবদুর রশিদ, ওয়াজেদ ও রায়হানকে কাজে লাগানাে হয়েছিল।
সূত্র : বাংলাদেশ সরকার ১৯৭১-৭৫ এইচ টি ইমাম